আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের গ্রহণের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। এ সময়ে নগদ অর্থ সরবরাহ কমে গিয়ে দেশটির অর্থনীতির সংকট আরও গভীরতর হয়েছে। একই সাথে জীবনের নানা ক্ষেত্রেও প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে সেখানে। আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান সীমান্ত দিয়ে একটি সেতু পেরিয়ে নতুন "ইসলামিক আমিরাতে" ঢুকছিলো একটি মালবাহী কার্গো ট্রেন। সীমান্তে উজবেকদের উল্টো দিকে তালেবানের সাদা কালো পতাকা উড়ছিলো। কিছু ব্যবসায়ী তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে স্বাগত জানিয়েছে। গম বোঝাই একটি ট্রাকের চালক বিবিসি সংবাদদাতাকে বলেন, যে এর আগে চেকপয়েন্ট পার হওয়ার সময় দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হতো। "এখন আর সেটি নেই। আমি কাবুলের পথে ড্রাইভ করে যেতে পারি কোন পয়সা না দিয়েই," বলে জানান তিনি। গত পনেরই অগাস্ট আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। দেশটিতে এখন নগদ টাকার সংকট। অর্থনীতিও গভীর সংকটে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় জানিয়েছে বাণিজ্য কমেছে ব্যাপকভাবে, কারণ আফগান আমদানিকারকরা অর্থ দিতে পারছে না। হাইরাতান বন্দরে তালেবানের হেড অফ কাস্টমস মৌলভী সাইদ বলছেন, বাণিজ্য বাড়াতে তারা শুল্ক কমিয়ে দিচ্ছেন এবং সম্পদশালী ব্যবসায়ীরা দেশে ফিরুক, সেটিকে তারা উৎসাহিত করতে চান। "এটি কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে। আর পরবর্তী জীবনে ব্যবসায়ীরা পুরস্কৃত হবেন," বলছিলেন তিনি। দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম শহর মাজার ই শরীফ থেকে এক ঘণ্টা ড্রাইভ দূরত্বে মানুষের জীবনযাত্রা মনে হল স্বাভাবিক, যদিও অনেকে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন। শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র ব্লু মসজিদ চত্বরে আগের মত আর তরুণ নারী পুরুষের দেখা মিলে না। এখন তালেবান লিঙ্গভেদে আলাদা সময়সূচী ঠিক করে দিয়েছে: নারীরা সকালে আসবেন আর পুরুষরা দিনের বাকী সময়। ব্লু মসজিদ চত্বরে এক নারী বলেন, সব ঠিক আছে। তবে হয়তো নতুন সরকারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষের বেশ কিছুটা সময় লাগবে। স্থানীয় প্রভাবশালী তালেবান নেতা হাজী হেকমতের কাছে প্রশ্ন ছিলো যে `আপনারা হয়তো নিরাপত্তা দিচ্ছেন কিন্তু সমালোচকরা বলছে আপনার এখানকার সংস্কৃতিকে হত্যা করছেন"।
তিনি উত্তর দেন: "না"।
"গত বিশ বছরে এখানে পশ্চিমা প্রভাব ছিল। চল্লিশ বছর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ এক বিদেশী থেকে আরেক বিদেশীর কাছে গেছে। আমরা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে হারিয়েছি। এখন আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনছি," বলছিলেন হেকমত। তার মতে, ইসলামে নারী পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধ। হেকমতকে মনে হল, মানুষের সমর্থনও উপভোগ করছেন। তবে কাছেই একজন বলছিলেন, "এরা ভালো লোক নয়"। হয়তো তালেবানের ইসলাম সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দেশটির রক্ষণশীল সমাজের সাথে খুব একটা আলাদা নয়। তবে বড় শহরগুলোতে এখনো তালেবানদের নিয়ে বিরাজ করছে গভীর সন্দেহ। হাজী হেকমতের মতে, এটি বছরের পর বছর ধরে তালেবান বিরোধী প্রোপাগান্ডার ফল। কিন্তু আত্মঘাতী বোমা হামলা কিংবা `টার্গেটেড কিলিং` এর ইতিহাসও এজন্য কম দায়ী নয়। ব্লু মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এক জায়গায় বড় একটি জটলা দেখা গেলো। সেখানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চারটি মৃতদেহ শুইয়ে রাখা হয়েছিল। একজনের পরিচয় হিসেবে লিখে রাখা হয়েছিল `অপহরণকারী` আর সতর্কতা ছিলো অন্য অপরাধীদের প্রতি যে শাস্তি হবে এমন। লোকজন সেখানে ফটো তুলছিল এবং নিজেদের অতীত ভুলে সামনের দিকে তাকানোর চেষ্টা ছিল তাতে। আফগানিস্তানের বড় শহরগুলোতে সহিংস অপরাধ দীর্ঘকালের সমস্যা। এখন তালেবানের সমালোচকরাও বলছেন, নিরাপত্তা বেড়েছে। একজন বলছিলেন, "এরা অপহরণকারী হলে ঠিক শাস্তিই হয়েছে। অন্যদের জন্য এটি বড় শিক্ষা হবে।" তবে শহরের অনেকেই আবার নিরাপদ বোধ করে না। আইনের ছাত্রী ফারজানা বলছিলেন, "যখনই ঘরের বাইরে যাই, তালেবানদের দেখি, ভয় লাগে।" বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা। কিন্তু সরকারিগুলো এখনো বন্ধ। তালেবানদের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, শ্রেণীকক্ষে ছেলে ও মেয়েদের এখন থেকে মাঝখানে পর্দা দিয়ে আলাদা বসতে হবে। ফারজানার কাছে এটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তার ধারণা তালেবান শেষ পর্যন্ত মেয়েদের কাজের অনুমতি দিবে না। এ মূহুর্তে যদিও শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া নারীদের নিরাপত্তার জন্য ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। "এ মূহুর্তে আশাহত লাগছে নিজেকে, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী হতে আমি আমার সর্বোচ্চটাই করে যাবো," বলছিলেন ফারজানা। এর আগেরবার যখন তালেবান ক্ষমতায় ছিল, তখন নিয়ননীতি আরও কঠোর ছিল। মেয়েরা তখন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে বের হতে পারতো না। আফগান শহরগুলো এখন সেই ভীতিই তৈরি হয়েছে যে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ওই রকমই হবে। দেশটির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বহু মানুষের হৃদয় জয় করা থেকে অনেক দূরেই আছে তারা।
হাজী হেকমত বলছিলেন, "সামরিকভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়া ছিল কঠিন। কিন্তু আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা ও একে সুরক্ষা দেয়া আরও কঠিন।" সূত্র- বিবিসি বাংলা