চলতি মাসের ১২ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের দপ্তরে ঢুকে সচিব ও হিসাব বিভাগের উপপরিচালক (ডিডি) অধ্যাপক বাদশা হোসেনের ওপর চড়াও হন অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও উপসচিব ওয়ালিদ হোসেনসহ তার সহযোগীরা।ওয়ালিদ হোসেন ও তার সহযোগীরা সচিবের কক্ষে ঘণ্টাব্যাপী ‘ত্রাস’ সৃষ্টি করেন। বোর্ডের দুই কর্মকর্তাকে হেনস্তার ঘটনাটি সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়ে।
ফুটেজে অফিসার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়ালিদ হোসেন সচিবের মুখের কাছে হাত নিয়ে তাকে চড় মারতে উদ্যত হতে দেখা যায়। এরপর সচিব ও ডিডিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে শাসান ও গালাগাল করেন তিনি।
উল্লেখ্য, হেনস্তার শিকার দুই কর্মকর্তা শিক্ষা ক্যাডার থেকে আসা এবং মন্ত্রণালয়ের নিয়োগের মাধ্যমে প্রেষণে শিক্ষা বোর্ডে দায়িত্বরত।
এদিকে, বোর্ড সচিব ও উপপরিচালক ঘটনার পরদিন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবর পৃথক পৃথক অভিযোগ দেন।
জানা গেছে, একই ঘটনার দায় চাপিয়ে সচিব ও উপপরিচালকের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান বরাবর পাল্টা অভিযোগ দেন ওয়ালিদ হোসেনসহ তার সহযোগীরা।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ঘটনার ৯ দিনেও বোর্ড চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় গত ২০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বার বোর্ড চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন হেনস্তার শিকার দুই কর্মকর্তা। সেই সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে সিসিটিভি ফুটেজ হস্তান্তর করেন।
দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো হেনস্তার শিকার বোর্ডের দুই কর্মকর্তার মধ্যে হিসাব বিভাগের ডিডিকেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা তলব করেছেন বোর্ড চেয়ারম্যান মোকবুল হোসেন।
ফলে অধঃস্তনদের হাতে হেনস্থার ঘটনাটির ফলাফল দাঁড়িয়েছে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো’, বলেছেন ভুক্তভোগী এক কর্মকর্তা।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো উপপরিচালককে শারীরিক হেনস্তার পর মানসিক পীড়নের উদ্দেশ্যেই এই শোকজ নোটিশ বোর্ড চেয়ারম্যান দিয়েছেন বলে মনে করছেন ঘটনার শিকার দুই কর্মকর্তার একজন। ভুক্তভোগী ওই কর্মকর্তা বলেন, বোর্ড চেয়ারম্যান কার্যত: ত্রাস সৃষ্টিকারী ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের হেনস্তাকারীদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। কারণ যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন তারা বোর্ড চেয়ারম্যানের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করেন না। আর বোর্ড চেয়ারম্যান তার প্রতিপক্ষ ভেবে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে প্রেষণে দায়িত্বরত শিক্ষা ক্যাডারের পাঁচ কর্মকর্তাকে অতীতেও এদেরকে দিয়েই নানাভাবে হেনস্তা করেছেন বহুবার। কোনো বারই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বেশকিছু কর্মকর্তা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে পদোন্নতি পেয়ে অফিসার হয়েছেন আগের চেয়ারম্যানের আমলে। সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ এমন ৯ জনকে কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেন। তবে পদোন্নতির পর নিয়ম বহির্ভূতভাবে জাতীয় বেতন স্কেলে তাদের প্রাপ্যতার অধিক বাড়তি গ্রেড দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা প্রাপ্য বেতন ও সুবিধার অধিক আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন।
এদিকে বর্তমান সচিব প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন ও ডিডি হিসাব অধ্যাপক বাদশা হোসেন নিয়ম বহির্ভূত হওয়ায় তাদেরকে বাড়তি বেতন গ্রেড দিতে আপত্তি জানিয়ে আসছেন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিন এই ধরনের পদোন্নতি পাওয়া কতিপয় কর্মকর্তার সার্ভিস ফাইলের নথিপত্র সেকশন থেকে ফটোকপি করে নিজের হেফাজতে নেন ডিডি। এসব নথিপত্র কেন ডিডি ফটোকপি করেছেন- তার প্রতিবাদ করতেই ওইদিন ওয়ালিদ হোসেন সচিবের দপ্তরে চড়াও হন। যেখানে আগে থেকে ডিডি বাদশা হোসেন মিটিং করছিলেন। ওয়ালিদরা ডিডিকে তুলে আনার চেষ্টা করেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ মতে, বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোকবুল হোসেনের সঙ্গে প্রেষণে দায়িত্বরত পাঁচ কর্মকর্তার দ্বন্দ্ব রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ‘ওপেন সিক্রেট’।
এদিকে সম্প্রতি বোর্ড চেয়ারম্যান ড. মোকবুল হোসেন আরও ছয় কর্মচারীকে কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দিয়ে সচিবকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। নিয়ম বহির্ভূত হওয়ায় বোর্ড সচিব ফাইলটি আটকে দেন। এতে আগে থেকে চলা দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়।
ঘটনার ১২দিন পরও অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া প্রসঙ্গে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোকবুল হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শোকজ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর তাতে কেউ অভিযুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বোর্ডের বাকি পাঁচ প্রেষণ কর্মকর্তার সঙ্গে তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি করেন তিনি। তাদের হেনস্থার সঙ্গেও তার কোনো যোগসূত্র নেই বলে জানান মোকবুল হোসেন।