মাসুম হাসান
ভাষা বদলায়, স্থান বিশেষে উচ্চারণ, নাম বদলে যায়। ফলে তারাপুর হয়ে যায় তারাবো, বেলাপুর হয় বেলাবো, মনোহরদীঘি হয়ে যায় মনোহরদী, নরসিংহদীঘি হয়ে যায় নরসিংদী।
লোকের মুখে মুখে উচ্চারণ বদলে যায়৷ এর আসল কারণ উচ্চারণকে সহজ করা৷ কোনো এলাকা বা স্থানের নাম বহু মানুষ বহু কাজে ব্যবহার করে, ফলে জায়গার নামগুলো অবশেষে সহজ থেকে সহজতর উচ্চারণ দাবী করে৷ এভাবেই শ্রীহট্ট হয়ে গেল সিলট, হবিবগঞ্জ হয়ে যায় হবিগঞ্জ৷ শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে যায় সাচনাগন। তেমনি কামরঙ্গ হতে পারে কামলঙ্গ, তার থেকে বদলে গিয়ে অবশেষে কুমিল্লা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার নামের শেষে কতগুলো কমন প্রত্যয় দেখা যায়৷ যেমনঃ পুর, গঞ্জ, দী, বাজার, হাট, খালী, ডাঙ্গা, গ্রাম/গাঁও/গাঁ ইত্যাদি৷ বর্তমান নিবন্ধে এই প্রত্যয়গুলোর সম্ভাব্য উৎস নিয়ে আলোচনা করা হলো৷
গঞ্জঃ
গঞ্জ মানে নদীর তীরে গড়ে উঠা বাণিজ্যপল্লী৷ আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল৷ ফলে বিভিন্ন নদীতীরবর্তী এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল৷ এমনি কিছু এলাকার নামের শেষে `গঞ্জ` যুক্ত হয়ে সেসব এলাকা পরিচিতি পেয়েছে৷ যেমনঃ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কালিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ৷
পুরঃ
পুর বা পুরী হল উল্লেখ করার মত বড়লোকী ঘর। যেসব অঞ্চলে বনেদী পরিবার বা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা বসতি স্থাপন করেছিল সেসব এলাকার নামের শেষে পুর প্রত্যয়টি যুক্ত হয়ে গেছে৷ যেমনঃ জামালপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর ইত্যাদি।
গাঁও/গাঁ/গ্রামঃ
স্থানের নামে থাকতে পারে গ্রাম, গাঁও, গাঁ৷ গ্রাম বা গাঁও কেন্দ্রিক জনপদের প্রসারের ফলে জায়গার নামের শেষে এই প্রত্যয়গুলো যুক্ত হয়ে থাকতে পারে৷ যেমনঃ সোনারগাঁও, নওগাঁ, নোয়াগাঁও, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, অষ্টগ্রাম, চৌদ্দগ্রাম৷
ডাঙ্গা/কান্দি/কান্দাঃ
ডাঙ্গা মানে বন্যায় তলিয়ে যায়না এমন উচুঁ জমি। কান্দি মানে যেখানে লোকে মাটি ভরাট করায় ডাঙ্গা হয়ে গেছে। এভাবে অনেক জায়গা পরিচিতি পেল ময়নাডাঙ্গা, জোড়াডাঙ্গা, আলফাডাঙ্গা, ঘুঘুডাঙ্গা ইত্যাদি নামে৷ আবার তারাকান্দি, সারিয়াকান্দি, কান্দির পাড় ইত্যাদি নামও আছে৷
এছাড়াও টান মানে উচুঁ জায়গা বা ডাঙ্গা। সেজন্য বহু নদীর পাড়েই আছে টান বাজার।
আইলঃ (ইংরেজি Isle)
সারাদেশে প্রাচীন বেশ কিছু নাম আছে যা আধুনিক বাংলা ভাষায় নেই৷ যেমনঃ টাঙ্গাইল, সরাইল, সওরাইল, শিমরাইল। এছাড়া আছে রাম্রাইল, নড়াইল, ঘাটাইল, বাসাইল, নান্দাইল, ধোবাইল, পূবাইল ইত্যাদি৷ এসব নামে আইল একটা স্থানবোধক প্রত্যয় যা সাধারণভাবে ক্ষেতের আইলকে বোঝায়৷ এসব আইল প্রশস্ত হতে হতে একসময় মূল রাস্তায় পরিণত হয়েছিল৷ ফলে সেসব এলাকার নামের সাথে আইল যুক্ত হয়ে গেছে৷
পাড়াঃ
প্রাচীনকালে যেখানে যেখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে উঠেছিল সেসব নামের শেষে ‘পাড়া’ শব্দটি জুড়ে যেত। পাড়াতে সাধারণত সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত লোকের বাস ছিল। যেমনঃ উকিলপাড়া, সেনপাড়া, হিন্দুপাড়া, মাষ্টারপাড়া, জেলেপাড়া৷ আবার কোনও কোনও পাড়া দিকের নামে পরিচিত। যেমনঃ উত্তর পাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া ইত্যাদি৷
ছড়ি/ছড়াঃ
বাঙলাদেশের পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি ঝর্ণাকে স্থানীয় ভাষায় "ছড়া" বলা হয়৷ এমন অসংখ্য "ছড়া" বা ঝর্ণা অনেক এলাকার নামের সাথে একীভূত হয়ে গেছে৷ খাগড়াছড়ি, হিমছড়ি, জুরাছরি, বিলাইছড়ি, মাইশছড়া, ভাইবোন ছড়া নামগুলো এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷
তলী/তলাঃ
একসময় এদেশের বহু অঞ্চল ছিল ফাঁকা ও বসতিহীন। এসব অঞ্চল পাড়াগাঁয়ের প্রচলিত রীতি অনুসারে কোনও স্থানীয় উল্লেখযোগ্য গাছের নামের সঙ্গে ‘তলা’ বা `তলী` শব্দ যুক্ত হয়ে পরিচিত হত। যেমনঃ আমতলী, জামতলী, বটতলা, চাঁপাতলা, ডালিমতলা, বেলতলা, কাঠালতলী, বাঁশতলা তালতলা ইত্যাদি৷
বাগ/বাগানঃ
একসময় এই উপমহাদেশে অবস্থাপন্ন বাঙালি ছাড়াও পারসি, ইহুদি, ফিরিঙ্গি সম্প্রদায়ের মানুষ অনেকটা জায়গা নিয়ে বাড়ি করতেন, কেউ কেউ শহর থেকে একটু দূরে বানাতেন বাগানবাড়ি। একসময় এই সব বড় বড় বাড়ি কিংবা বাগানবাড়ি ভেঙে বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে এবং অঞ্চলের নামের শেষে যুক্ত হয় ‘বাগান’ বা বাগ শব্দটি।
বাগ হলো বাগানের সংক্ষিপ্ত কথ্য রূপ৷ ফুল বা ফলের বাগানের নাম এলাকার নামের শেষে মিলে গিয়ে হলো- আমবাগ, কাঠবাগান, প্রেমবাগান, কলাবাগান, কাঠালবাগান, বাগবাড়ি ইত্যাদি৷
বাজারঃ
মগবাজার, মৌলভীবাজার, বড়বাজার, নতুনবাজার, শ্যামবাজারের মতো বহু অঞ্চলের শেষে ‘বাজার’ শব্দটি জুড়ে আছে। যদিও অনেক অঞ্চলে বর্তমানে আর সেসব ঐতিহ্যবাহী বাজার দেখা যায় না। দেখা গেছে কোথাও কোথাও ব্যক্তিনাম কিংবা পদবীর পরেও বাজার শব্দটি যুক্ত হয়েছে। যেমনঃ কক্সবাজার(Cox সাহেবের বাজার), ফিরিঙ্গি বাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজার, সাহেববাজার, বউবাজার, জামাইবাজার৷
পুকুরঃ
নিচু অঞ্চলগুলিতে বসতি গড়ে তোলার প্রয়োজনে অনেক সময় পুকুর খনন করে তার মাটি ব্যবহার করা হত। এইরকম বড় আকারের কোনও জলাশয়ের আশেপাশে যে বসতি গড়ে উঠত তাদের নামের পরে ‘পুকুর’ শব্দটি জুড়ে যেত। যেমন, শ্যামপুকুর, কাঁটাপুকুর, মিঠাপুকুর, জোড়পুকুর ইত্যাদি৷
বিখ্যাত লোকের নামেঃ
লোকের নামে হতে পারে জায়গার নামঃ আনন্দবাবুর বাজার থেকে আনন্দবাজার, জগৎবাবুর বাজার থেকে জগৎবাজার, এনায়েত আলির গঞ্জ হলো এনায়েতগঞ্জ, নারায়ণ বাবুর গঞ্জ সহজ উচ্চারণে হলো নারায়ণগঞ্জ; বোগড়া খান থেকে বগুড়া। চট্টগ্রামে আছে `জামাল খান`, `এ কে খান`৷
ফসল/ফুল/ফলের নামেঃ
ফল, ফুল বা ফসলের নামে হতে পারে এলাকার নামঃ কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, লিচুবাগান, বকুলপুর, তালশহর, তালতলা, পাটগ্রাম, ধানসিঁড়ি, গোলাপগঞ্জ ইত্যাদি৷
পশুপাখির নামেঃ
ময়মনসিংহ, বাঘের বাজার, টাইগার পাস, বান্দরবান, বান্দর মার্কেট, সাপমারা, সর্প মুড়া, গুইমারা, কুমিরা, হরিনছড়া, গাইবান্ধা, ছাগলনাইয়া, ভেড়ামারা, হাতিরদিয়া, এলিফ্যান্ট রোড, শিয়ালদহ, শালিকচূড়া, বিলাইছড়ি, ঘুঘুডাঙ্গা, ময়নাগঞ্জ, বাবুইছড়া ইত্যাদি স্থানের নাম পশুপাখির নামের সাথে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত হয়ে প্রচলিত হয়ে গেছে৷
সংখ্যাযুক্ত নামঃ
অনেক জায়গার নামের আগে-পিছে সংখ্যা যুক্ত হয়ে নামগুলো প্রচলিত হয়েছে৷ পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, পঞ্চবটী, চৌরাস্তা, তোমাথা, সাতমাথা, বিশমাইল, আড়াইহাজার, লাকপুর(লাখ), আঠারোবাড়ি, বত্রিশ, ষোলশহর ইত্যাদি হলো তেমনি কিছু অঞ্চলের নাম৷
আধুনিক কাব্যিক নামঃ
কাব্যিক নামগুলি সাম্প্রতিক কালের। যেমনঃ বসুন্ধরা, বনানী, বনশ্রী, বারিধারা, বসুমতি, পল্লবী, জলসিড়ি, নতুনধারা ইত্যাদি৷
এছাড়াও শহরে বাণিজ্য অঞ্চলে থাকতে পারে পট্টি৷ পট্টি মানে পাটের চট বিছিয়ে তাতে মাল রেখে দেওয়ার জায়গা। পট্ট মানে পাট, চট্ট মানে চট। মেথরপট্টি, ঘোড়াপট্টি, হুক্কাপট্টি, শাঁখারিপট্টি, কশাইপট্টি, চুড়িপট্টি, কামারপট্টি, তালপট্টি ইত্যাদি নাম সবাই কমবেশি শুনে থাকি৷
অশ্লীল নামঃ
আবার কিছু জায়গার নাম শুনলে অশ্লীল মনে হয়৷ অনেকে সহজে এই নামগুলো মুখে আনতে চান না৷ যেমনঃ
বোদা (পঞ্চগড় জেলার একটি উপজেলা),
বড়বাল (রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইউনিয়ন)
ধনকামড়া (দিনাজপুরের ভোদামারার একটি গ্রাম)
সোনাখাড়া (সিরাজগঞ্জ জেলার একটি ইউনিয়ন)
সোনাকাটা (বরগুনা জেলার একটি ইউনিয়ন)
ধনবাড়ি – (টাঙ্গাইল জেলার একটি উপজেলা)
কানকির হাট (নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে অবস্থিত যা এখন খানকির হাট নামে পরিচত)
গোয়াকাটা (ঢাকার দোহার উপজেলায় অবস্থিত)
শাওয়াপাড়া (সিলেট জেলায় অবস্থিত)
গোয়াতলা (ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত)
লেংটার বাজার (চাঁদপুর জেলায় অবস্থিত)
ধনতলা (ঠাকুরগাঁও এর রুহিয়া থানার একটি গ্রাম)
সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়(খুলনা জেলায় অবস্থিত)
চুমাচুমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত)
এসব নাম কীভাবে প্রচলিত হয়ে গেল তার ইতিহাস হয়ত এখন আর কেউ জানতে চেষ্টা করে না৷
তবে নাম যাই হোক, এসব জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মিলিয়েই বাংলাদেশের সবকিছু গড়ে উঠেছে যেমনটি পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই একরকম৷
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক নতুন বাজার ৭১.কম
|