এস.কে.দোয়েল।। সবুজ চা বিপ্লবে ঘুরে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়া। তিনদিক বেষ্টিত ভারতের কোলে এ উপজেলার অবস্থান। সীমান্ত ঘেষা এ উপজেলা হওয়ায় এখানেও ক্রমাগতভাবে বাড়ছে চা চাষ। সমুদ্র পৃষ্ঠ অনেক উপরে থাকায় এ অঞ্চলটিতে বর্ষাকালে তেমন বন্যা হয়না। তাই ভূমি উচু হলেও বেলে মাটি যুক্ত সমতল এখানকার জমাজমি। যে ভূমিতে বিগত সময় ধরে কৃষকরা আবাদ করে আসছিল ধান, পাট, আখ থেকে শুরু করে নানা ধরনের সবজি। এখানকার জমিতে ধানের তেমন উন্নত ফলন না হওয়ায় কৃষকরা পাট, আখ ও সবজি চাষ করেই পরিবারের খাদ্য সংস্থান করে আসছে। তবে এ অঞ্চলে সারা বছরই ব্যাপক শাক-সবজির বাম্পার ফলন হয়ে থাকে। এ সবজিগুলো এখানকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাসহ রাজধানীতেও চাহিদা মেটালেও কাংখিত ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলত সবুজ শাক সবজ্বি, আলু, মূলা, কপি, টমেটো ইত্যাদি জাতের রবি শস্য ও ধান চাষাবাদ করে সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারা এবং বাজারে আশাতীত দাম না পাওয়ার অন্যতম কারণই এসব ফসল উৎপাদনে হতাশ হয়ে আগ্রহ হারানোয় চা চাষের দিকে ঝুঁকছেন তারা। অপরদিকে এ অঞ্চলের বেঁলে বালু দোঁ-আশ মাটির নীচে রয়েছে বিপুল পরিমাণ নুঁড়ি পাথরের খনি। একশ্রেণির পাথর ব্যবসায়ী চাষীদের জমিতে ছোট ছোট গর্ত বা কুপ খনন করে পাথরের খনি সন্ধান পেলেই জমির মালিককে মোটা অংকে ম্যানেজ করে সাময়িকভাবে পাথর উত্তোলণের জন্য জমিটুকু শর্তসাপেক্ষে লীজ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক চাষী ফসলের তুলনায় স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা দেখে আবাদি জমি খনন করে পাথর উত্তোলণের জন্য ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি লীজ দিচ্ছে। উপজেলার কাজীপাড়া, দর্জিপাড়া, মাঝিপাড়া, বালাবাড়ী, শালবাহান ডাহুক, রওশনপুর, কালিতলা, বুড়াবুড়ী, ভজনপুর, কাউরগছ, হারাদিঘি, ঝালিঙ্গি, কাটাপাড়া, সাতমেরা, দেবনগরসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পাথর উত্তোলন চলছে। এ পাথর উত্তোলণের ফলে মালিক ও ব্যবসায়ীরা ধনবান হলেও এসব স্থানগুলো প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে এসব জমিতে বালুময় অবস্থা তৈরি হওয়ায় অন্য কোন আবাদ ফলার সম্ভাবনা নেই বিধায় স্থানগুলো মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে পাথর উত্তোলনের কাজে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। যার কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পাথরের জন্য বিখ্যাত বলে মনে করা হয় তেঁতুলিয়াকে। একদিকে সবজির বাম্পার ফলন, অপরদিকে পাথরের রাজ্য আবার অন্যদিকে যুক্ত হয়েছে চা চাষের হিরিক। এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন টি কোম্পানী। এদের মধ্যে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট, আগা ইন্ডাস্ট্রিসহ বেশ কিছু চা কোম্পানী গড়ে উঠায় বাড়ছে চা চাষ। এর মধ্যে প্রবেশ করেছে ইউরোপীয়ান একটি সংগঠন। তারা চা চাষকে উদ্ধুব্ধ করতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা চাষীদের নিয়ে গঠন করেছে এক একটি সংগঠন। বিনামূল্যে বিতরণ করছে চা চারা। চা চাষের বিপ্লব ঘটাতে ক্ষুদ্র চাষীদের বাড়ির আঙিনা কিংবা পাশে কোন পতিত জমিন থাকলেই উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে চা চাষ করার। কেননা এদেশের প্রচুর চা পান করে থাকে। এছাড়াও চা চাষ দীর্ঘকালীন ফসল। একটি চা গাছের আয়ু একশ বছর। ফলে একটি বাগান করতে পারলে দীর্ঘ সময় সেই বাগান থেকে চা পাতা উঠিয়ে রপ্তানীসহ ব্যাপক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে মর্মে সবুজ চা চাষে বাড়ছে কৃষকদের অত্যাধিক আগ্রহ। এতে করে কৃষকরা অন্যান্য আবাদ থেকে দূরে সরে আসায় ধান ও আখ চাষের জমির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হ্রাস পাচ্ছে। তেঁতুলিয়া কৃষি সম্প্রসারনের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় মোট জমি রয়েছে ১৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষাবাদের জমি রয়েছে ১৪ হাজার হেক্টর। এত স্বল্প পরিমাণ জমি ঘিরে চাষাবাদের জমি খনন করে নুঁড়ি পাথর উত্তোলনসহ বৃহৎ ও ক্ষুদ্র পরিসরে বর্তমানে শুরু হয়েছে চা বাগানের প্রতিযোগিতা। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ১ হেক্টর করে ধান চাষাবাদের জমি হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে তেঁতুলিয়ায় ১ হাজার ২শত ৯০ হেক্টর জমিতে সবুজ চা বাগান গড়ে উঠেছে। তবে তেঁতুলিয়ায় চা চাষাবাদে চাষীদের আগ্রহ বাড়ার বেশি দিনের নয়। ১৯৯৭-৯৮ সময়ে সর্বপ্রথম এখানে টিটিসিএল নামক কোম্পানী ক্ষুদ্র পরিসরে মাঝিপাড়া, ডাহুক, বালাবাড়ি ও খুটাগছ এলাকায় প্রাথমিকভাবে শুরু করে সবুজ চা চাষ। এরপর রওশনপুরে কাজী এন্ড কাজী টি এসেস্ট লিমিটেড বৃহৎকারে অর্গানিক পদ্ধতিতে সবুজ চা চাষাবাদ শুরু করে। এই কোম্পানীর অধিনে উপজেলার লোহাকাচি, রওশনপুর, বালাবাড়ি, দর্জিপাড়া, সারিয়ালজোত, সাতমেরা, দেবনগরসহ পঞ্চগড় জেলার বেশ কিছু এলাকায় চা বাগান গড়ে তুলে। এভাবে পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলে সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকার বেশ কিছু চা কারখানার মালিক তেঁতুলিযায় জমাজমি কিনে চা চাষ শুরু করেছে। বর্তমানে তেঁতুলিয়ায় ১১টি বড় ধরণের চা বাগানসহ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চা বাগানের সংখ্যা প্রায় সহস্রাধিক ছড়িয়েছে। এসব বাগানের উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ১৮/২২/২৪/২৬ টাকা কেজি হিসেবে টিটিসিএল চা কারখানা, গ্রীণ এগ্রো কেয়ার চা কারখানা, করতোয়া চা কারখানা, নর্থ বেঙ্গল কারখানা ও ভজনপুর ফিলিং স্টেশনের মালিক আব্দুল জব্বারের চা কারখানায় চাষীরা নিজস্ব পরিবহণ পিকআপ ও ব্যাটারি চালিত ভ্যান নিয়ে বিক্রি করছে।
চা শিল্প ঘিরে ক্রমাগত বাড়ছে যেমন নতুন নতুন চাষী, তেমনি চা বাগানের পরিচর্চা, পাতা তোলা/ছিড়া, ছাটাই বাছাইয়ের এসব কাজে শ্রম জীবীরা পাচ্ছেন কাজ। দল বেঁধে কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। এসব শ্রমিকের মধ্যে রয়েছেন নারী, পুরুষ ও মধ্য বয়সী কিশোর-যুবাসহ ২০ হাজার শ্রমিক। যাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে উত্তরের এই জনপদে জেগে উঠা চা শিল্প। আর এতে চা চাষীদের বিভিন্ন রকম সুবিধা দিচ্ছেন কিছু বেসরকারী সংস্থা। এসব সংস্থার মধ্যে বিকাশ বাংলাদেশ অন্যতম। এ সংস্থা চা চাষে উদ্বুদ্ধ করণের লক্ষ্যে বাগান সৃজনের জন্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চা চাষীদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দিতে দিচ্ছেন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ। এসব ঋণ সহায়তার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র চা চাষীরা তাদের বসতবাড়ির আশপাশসহ পতিত জমিতে চা চারা রোপন করে ছোট ছোট বাগান করেছে। উত্তরের এই জনপদে চা শিল্পের বিস্তার ঘটলেও চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল আখ ও আনারস চাষ। চা বাগান অত্যাধিক বৃদ্ধির ফলে কমে যাচ্ছে এই দুটি ফসলের চাষবাদ। যার ফলে ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়েছে জেলার একমাত্র ভারি শিল্প ‘পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠানটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছরই লোকসানের মুখে রয়েছে এই কারখানাটি। অথচ লোকসানের হাত থেকে একমাত্র শিল্প কারখানাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পঞ্চগড় চিনিকলের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রীতিমত গ্রামে গ্রামে ঘুরে আখ চাষীদের মাঝে ঋণ প্রদান, ভূতর্কিসহ নানান সুযোগ সুবিধা দিয়ে আখ চাষের জন্য আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করে কোন রকম টিকে রয়েছে এ ভারি শিল্প কারখানাটি। আখ উৎপাদিত হলেও সঠিক সময়ে এর যথাযথ মূল্য বাজারে বিক্রি না করতে না পেরে চাষীদের বিক্রিত আখের মূল্য পরিশোধেও মিলস কর্তৃপক্ষ হিমসিম খাচ্ছে। প্রতি বছরই টনকে টন মজুত থাকে চিনি। ফলে এসব চিনি বিক্রি না হওয়ায় কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে চিনি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে যাই হোক, সবুজ চা বিপ্লবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে উত্তরের এই জনপদ। চা অর্থকরী ফসল হিসেবে অর্থনীতির নতুন চাকা ঘুরবে এর চাষাবাদে। তবে এসব বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূমি মালিকদের ভূমি ব্যবহারের জন্য নানামুখী প্রদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনার কথা চিন্তাভাবনা করছে। যতদ্রুত সম্ভব এখানে ভূমি জোনিং ও প্লানিং কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা যেখানে বিশাল অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে সেখানে সবুজ চা বিপ্লবে আরেকধাপ এগিয়ে যাবে হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ের এই উপজেলাটি।
|