নতুনবাজার৭১ডটকম ডেস্ক নিউজঃ
টানা একহাজার দিন ধরে হেটে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পাড়ি দিয়েছেন একা একজন নারী। দশ হাজারেরও বেশি মাইল পথ হেঁটে একজন নারী দুটি মহাদেশের ছয়টি দেশ পাড়ি দিয়েছেন। সাইবেরিয়া থেকে পৌছেছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
অসম্ভবকে সম্ভব করা এই নারী সুইজারল্যান্ডের সারাহ মারকুইস। ৪৩ বছর বয়সী এই পর্যটক অবিশ্বাস্য তার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে লিখেছেন সুইস ভাষায়‘এলেইন ওয়াল্ডনিস’ যার ইংরেজি অনুবাদ “ ওয়াইল্ড বাই নেচার”।
ওয়াইল্ড বাই নেচার বইয়ে তিনি বলেছেন, আমি এজন্যই হেটেছি যে আমি আদিম মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছি। আমি হেটেছি নিভৃত পথ দিয়ে, বেশিরভাগ সময় প্রকৃতি থেকে বা শিকার করে নিজের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। কাজটা তাই ছিল অনেক কঠিন।
তিনি বলেন, "আমি চেয়েছিলাম মানব সভ্যতার একেবারে গোঁড়ায় ফিরে যেতে। ৬০ হাজার বছর আগে আদিবাসীরা এই ভাবে বাস করতো। কিন্তু এভাবে খাবার খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। পৃথিবীতে খাবারের জন্য মানুষের যে সংগ্রাম সেটা আসলে আদিম সংগ্রাম। এই সময়েই আমি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।"
তিনি বলেন, "টানা তিনবছর ধরে হেটেছি। এই সুদীর্ঘ ভ্রমণে পায়ে ৮ জোড়া জুতার তলি ক্ষয়ে গেছে। অতিক্রম করেছি ২টি মহাদেশ এবং ৬টি দেশ। এ সময়ে পান করেছি ৩ হাজার কাপ চা।"
সারাহ মারকুইস সুইজারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের জুরা পর্বতমালার একটি ক্ষুদ্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বেড়ে উঠেছেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। সুইস পল্লী অঞ্চলের প্রকৃতি, গাছপালা এবং পাখিরাই ছিল সারাহর সঙ্গী। এরাই আসলে তাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল বাকি পৃথিবীর প্রতি। কেমন দেখতে পৃথিবীর অচেনা সব পাহাড়-মরু-সাগর?
৮ বছর বয়সে সারাহ একবার তার পোষা কুকুরকে নিয়ে ঘর পালিয়েছিলেন। সারা রাত কাটিয়েছিলেন একটি গুহার মধ্যে। রোমাঞ্চের প্রতি তার টান রয়েছে খুব ছোটবেলা থেকেই। যতই বড় হয়েছেন তার রোমাঞ্চের নেশা আরও বেড়েছে, তিনি গিয়েছেন দূর দূরান্তে।
সারাহ বলেন, "এটা ছিল আমার শৈশবের একটা স্বপ্ন। ভেতর থেকে কেউ একজন আমাকে সবসময় একটা তাগাদা দিত। আমি প্রকৃতিকে বুঝতে চাইতাম, বুঝতে চাইতাম আমার ভেতরের আমিকে।"
২০১০ সালে তিন বছর মেয়াদি এই ভ্রমণের সূচনা হয়েছিল সাইবেরিয়া থেকে। সেখান থেকে তিনি গোবি মরুভূমি পাঁড় হয়ে, চীন, লাওস এবং থাইল্যান্ডে পৌঁছলেন। থাইল্যান্ড থেকে উঠে বসলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনগামী একটি মালবাহী নৌকায়। ব্রিসবেনে পৌঁছে পাড়ি দিলেন সম্পূর্ণ অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। তার এই আশ্চর্য ভ্রমণে সমাপ্তি হয়েছিল মরুভূমির একটি গাছ তলায়। এই গাছ তলাটি সারাহর কাছে ছিল বিশেষ একটি জায়গা। তিনি এই জায়গাটা প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন এক যুগ আগে।
যাত্রাপথে শুধু খাওয়ার সমস্যাই না, সারাহকে পোহাতে হয়েছে আরও অনেক সমস্যা। মন এবং শরীর সুস্থ রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে হয়েছে তাকে। তিনি আমি বলেন, "আমি আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে যে রকম স্থির ছিলাম, তেমনি গোটা জিনিসটা ভাগ ভাগ করে এক ধাপ একধাপ করে এগিয়েছি। আমাকে সদা সচেতন থাকতে হয়েছে।"
তবে এটা তিনি করেছেন বেশ কয়েকবার বিপদে পড়ার পর। বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি বলেন, "আমি তখন গোবি মরুভূমিতে ক্যাম্প করে ছিলাম। ভোর ৫ টার দিকে আমার তাবুর চারপাশ ঘিরে ধরলো ৫টা নেকড়ে।" তবে সহজে ভয় পাওয়ার মত নারী সারাহ নন। নেকড়ের উপস্থিতি তাকে পৃথিবীতে নিজের উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করে দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও আরও অনেক প্রাণী রয়েছে। প্রকৃতিতে মানুষই সব না।
একজন নারী হয়ে এই ভয়ানক ভ্রমণ তার জন্য সহজ ছিল না। অনেক জায়গাতেই প্রচণ্ড শারীরিক ধকল গেছে তার উপর দিয়ে। লাওস জঙ্গলে বন্দুকধারী মাদক ব্যবসায়ীরা আক্রমণ করে তাকে। এটা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার মতোই ভয়াবহ ব্যাপার। তিনি বলেন, "একজন নারী হিসেবে আমি গর্বিত। কিন্তু যাত্রা পথে মাঝে মাঝে এও ভেবেছি যে, আমার যদি পুরুষের পেশী শক্তি এবং লোমশতা থাকতো তাহলে ভালো হত।"
নারী হওয়ার কারণে তাকে যে সমস্ত সমস্যায় পড়তে হয় সেটা এড়ানোর উপায় নেই বলে মনে করেন সারাহ। তিনি বলেন, "কিছু কিছু দেশ অতিক্রম করার সময় আমাকে পুরুষের ছদ্মবেশ নিয়ে থাকতে হয়েছে। কারণ সেখানে নারীদের অধিকার নেই। যেমন, চীনের কিছু কিছু অঞ্চলে একলা নারীকে বিবেচনা করা হয় যৌনকর্মী হিসেবে।"
সারাহ বলেন, মানুষ যখন সাগর, মরু, পাহাড় এবং প্রকৃতির কাছাকাছি যায় তখন সেই শক্তিশালী নেশা উকি দেয়। পুরোপুরি বিষয়ী মানুষও হয়ে পড়েন উদাসিন। মানুষের উচিৎ এই নেশা আরও বেশি করে অনুভব করা। এটা প্রকৃতির সাথে একাত্মতার নেশা। সারাহ বলেন, গোবি মরুভূমির মাঝখানে যখন একলা হেঁটেছি আমি, তখন এই একাত্মতাই ছিল আমার সঙ্গী।
|