সূর্যটা যেন দেখা দিয়েও দিচ্ছে না। এই রোদ তো এই মেঘের ছায়া। এমন বহুরূপী আকাশের নিচে কালো সামিয়ানায় নিথর দেহে শুয়ে আছেন বরেণ্য অভিনেতা মাসুম আজিজ। তাকে শেষ দেখার জন্য হাজির নাট্যজগতের শিল্পী-কলাকুশলীরা। তাদের মুখ মলিন, কারও আবার চোখের কোণে জায়গা করে নিয়েছে জল। কারণ দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে যে মানুষটা নাটকের মধ্যে ডুবে ছিলেন, সবার সঙ্গে মিশে ছিলেন, তিনি আর নেই।মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয় মাসুম আজিজের মরদেহ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এই শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে এসেছেন নন্দিত অভিনেতা ও রাজনীতিক আসাদুজ্জামান নূর, কিংবদন্তি অভিনেত্রী দিলারা জামান, অভিনেতা মামুনুর রশীদ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাদের চৌধুরী, আহসান হাবিব নাসিম, নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু, চয়নিকা চৌধুরী, আব্দুন নূর সজলসহ অনেকেই। নাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও মাসুম আজিজের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়।
মাসুম আজিজ শুধু অভিনেতা নন, গানের মানুষও ছিলেন। তার সরল-সুরেলা গায়কীতে মুগ্ধ হতেন আশেপাশের মানুষেরা। তাই বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সমবেত কণ্ঠে গান গেয়েই অভিনেতাকে শেষ বিদায় জানানো হয়। গানটি হলো- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি’। উপস্থিত বিখ্যাতজনেরাও মাসুম আজিজের স্মরণে গানটিতে কণ্ঠ মেলান।শ্রদ্ধা জানাতে এসে আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, “মাসুম আজিজ একুশে পদক পাওয়ার একটি অনুষ্ঠান হয়েছিলো, সেখানে একটি কথা বলেছিলো সে, ‘আমি সারাজীবন শুধু নাটক করতে চেয়েছি, অন্য কিছু নিয়ে ভাবিনি। এই উচ্চারণটা আমার কাছে সাহসী উচ্চারণ মনে হয়েছিলো। কারণ আমাদের এই দেশে শুধু নাটক করে বেঁচে থাকার যে প্রত্যয়, সেটি আমরা আমাদের জীবনে রাখতে পারিনি। আমরা অনেক আপোষ করেছি জীবনের সঙ্গে। কিন্তু মাসুম ছিলো আপোষহীন এবং অনেক সাহসী। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি তাকে কখনও মনোবল হারাতে দেখিনি। এইতো সপ্তাহ দুয়েক আগেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তখনও দেখেছি, বেঁচে থাকার বিপুল শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে, সেটি আমি ভুলবো না। মাসুম আজিজ চলে যাওয়া মানে, অঙ্গীকারাবদ্ধ নাট্যব্যক্তি যারা, তাদের মধ্যে একজন প্রধান ব্যক্তি আজকে চলে গেলেন। আমি এই মহান শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।”বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ও নাট্যজন মামুনুর রশীদের সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন মাসুম আজিজ। নিজের শিষ্যের প্রয়াণে তাই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বক্তব্য রাখতে গিয়ে বারবার তার গলা ধরে আসে, ভিজে আসে চোখ। তিনি বলেন, ‘একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ছে খুব, একটি অনুষ্ঠান থেকে মাসুম গান গেয়ে ফিরছিলো, ভূপেন হাজারিকার গান; আমি ফিরছিলাম নাটক করে। দুজন রিকশায়; ও জানালো দেশে চলে যাবে। জানতে চাইলাম কেন? কারণ সবরকম বৈষয়িক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়েছে। আমি তখন চট করেই বলে ফেললাম, তুমি থাকো, আমি দেখবো। সেই থেকে ও আমার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলো। আর ঢাকা পদাতিকের সঙ্গে তো সে আছেই। তার সেইসব নাটকে অভিনয় দেখে আগে থেকেই আমি মুগ্ধ ছিলাম।’অভিনেতা নাদের চৌধুরীর সঙ্গেও দীর্ঘদিনের সখ্য ছিলো মাসুম আজিজের। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে এ অভিনেতা বললেন, “প্রায় তিন-চার যুগের সম্পর্ক; অনেক আনন্দ, কষ্ট, ভালোলাগার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। আর এই ইতিহাস যদি বলতে যাই, তাহলে অনেক লম্বা সময় লাগবে। অসুখটা হওয়ার পর উনি আমাকে ফোন দিয়ে বলেছেন, ‘নাদের আপনি আসেন, আপনি আসলে আমি অর্ধেক ভালো হয়ে যাবো’। কিন্তু আমি তো মনে মনে জানতাম, এই অসুখ সারবার নয়, মাসুম ভাইকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। চুপিচুপি যেতাম, বসতাম, গল্প করতাম, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য যদি ভালো থাকে। মাস খানেক আগেও তাকে বলেছি, মাসুম ভাই সুস্থ হন, নাটক করতে হবে না? একটা স্ক্রিপ্ট দেন আমাকে। দরকার হলে আপনার বাসায় রিহার্সাল করবো। উনি আমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিয়েছেন। (কাঁদতে কাঁদতে) কাজটাই শুরু করা হয়নি, করবো। মাসুম ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাক, এই কামনা করি।”সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “সংগঠনের সম্মেলন থাকার কারণে মাসুম ভাইয়ের অসুস্থতার সময় যেতে পারিনি। কিন্তু টেলিফোনে খবর নিয়েছি। ৯ অক্টোবর সম্মেলন শেষ হলো, ১০ তারিখেই আমি চলে গেলাম মাসুম ভাইয়ের বাসায়। সেদিনই তার সঙ্গে কথা হলো, আমি বিস্মিত হয়েছি তার মনোবল দেখে। একজন মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তারপরও তিনি বলছেন, ‘আমি ঠিক হয়ে যাবো। আবার নাটক করবো’। আমরা কী বলবো, তিনিই আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। সেই মানুষটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।”মাসুম আজিজের পুত্র উৎস জামান কান্না চেপে বলেছেন, ‘আমি আসলে কী বলবো! আমার বাবাকে যে দেশের মানুষ কেমন ভালোবাসেন, সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। গত দশ মাসে আমাদের যে যুদ্ধে যারা পাশে ছিলেন, একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, তাদের প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার মতে, আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ছিলেন। উনি অনেক সংগ্রাম করেছেন, কষ্ট করেছেন, কিন্তু সেই কষ্টটা সন্তানদের স্পর্শ করতে দেননি। মৃত্যুর আগে আমিই বোধহয় শেষ ব্যক্তি, যে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনি আমাকে বলেছেন, ‘আমি ঠিক হয়ে যাবো। তুমি কাঁদবে না’। উল্টো আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বাবা আমাদের এভাবেই সাহস দিয়েছেন। আমার বাবার ওপরে তো আসলে কোনও বাবা হয় না।”শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো শেষে মাসুম আজিজের মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর অভিনেতার নিথর দেহ নিয়ে ফ্রিজার ভ্যান রওনা করে পাবনার ফিরোজপুরের উদ্দেশ্যে। সেখানেই দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে তাকে।
|