বিদেশ থেকে আসা কল বা আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের রেট পুনর্নির্ধারণ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এক্ষেত্রে রাজস্ব ভাগাভাগির জন্য পৃথক সিলিং নির্ধারণ না করায় বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। এমনটাই বলছেন টেলিকম বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহকরাও এর কোনো সুফল পাবেন না। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মোবাইল ফোন অপারেটররাও। এদিকে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব বিটিআরসিতে চিঠি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসির উপপরিচালক সাবিনা ইসলামের স্বাক্ষরে বিটিআরসি আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের মূল্য পুনঃনির্ধারণের নির্দেশনা জারি করে। এতে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কল টার্মিনেশন রেট হবে ৫১ পয়সা মিনিট। যা আগে ছিল প্রায় দেড় টাকা। এতে আরো বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল কল টার্মিনেশন রেট পুনর্নির্ধারণের পাশাপাশি এখন থেকে সর্বনিম্ন হারের (ফ্লোর রেট) ভিত্তিতেই রাজস্ব ভাগাভাগি হবে। তবে সর্বোচ্চ কলরেট নির্ধারণ করা হয়নি এবং রাজস্ব ভাগাভাগিও অপরিবর্তিত রয়েছে। আগে সরকার দেড় টাকার রাজস্ব পেলেও এখন পাবে ৫১ পয়সার রাজস্ব।
তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক ইত্তেফাককে বলেছেন, বর্তমান বাজারের অবস্থা পরীক্ষানিরীক্ষা করেই বিটিআরসি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে সিদ্ধান্তের আগে মোবাইল ফোন অপারেটরসহ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। বৈধ পথে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল নিয়ে আসাকে উত্সাহিত করতেই এ সিদ্ধান্ত। আগে অনেক বেশি ভিওআইপি হচ্ছিল। ফলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। অনেক গবেষণা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিটিআরসির নির্দেশনা জারির পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি অ্যামটব থেকে চিঠি দেওয়া হয় বিটিআরসিকে। সেখানে বলা হয়েছে, বিটিআরসির এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন অপারেটরদের আয়ের ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি এ খাত থেকে সরকারি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও বড়ো অঙ্কে কমিয়ে দেবে। চিঠিতে হিসেব দিয়ে বলা হয়, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি মাসে ৮৮৮ মিলিয়ন বা ৮৮ কোটি ৮০ লাখ মিনিট ইনকামিং কল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দেশে আসছে। এ হিসেবে আগের সর্বনিম্ন মূল্য দেড় টাকা হারে রাজস্ব ভাগাভাগির হিসেবে প্রতি মাসে বিটিআরসির রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫২ কোটি ৯০ লাখ এবং এনবিআরের ভ্যাট ও কর বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১৩২ কোটি ১০ লাখ টাকা। বিটিআরসির পুনর্নির্ধারিত ৫১ পয়সা মিনিট হারে রাজস্ব ভাগাভাগি হলে যদি ১০ শতাংশ কলের পরিমাণও বাড়ে তাহলে এখন থেকে প্রতি মাসে বিটিআরসির রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হবে ৪৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাত্ নতুন সিদ্ধান্তের ফলে বিটিআরসি প্রতি মাসে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা এবং এনবিআর প্রায় ৮৩ কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে। সব মিলিয়ে তাদের রাজস্ব হারানোর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১১৬ কোটি টাকা। এ হিসেবে এখন থেকে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল থেকে বছরে সরকারের মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমবে ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।
হিসেবে বলা হয় বিটিআরসির নতুন সিদ্ধান্তের কারণে যদি ২০ শতাংশ করেও ইনকামিং কল বৈধ পথে বাড়ে তাহলে বিটিআরসির রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ প্রতি মাসে ৩১ কোটি টাকা এবং এনবিআরের রাজস্ব আদায় ৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা কমবে। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে রাজস্ব আদায় কম হবে ১০৮ কোটি টাকা। এ হিসেবে বছরে সরকারের মোট রাজস্ব আদায় কম হবে ১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা।
তবে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরদের (আইজিডাব্লিউ) সংগঠন আইওএফের প্রধান শামসুদ্দোহা ইত্তেফাককে বলেন, ‘অপারেটরদের হিসাব ঠিক নেই। এই সিদ্ধান্তের আগে প্রতি মাসে গড়ে ৫২ কোটি মিনিট কল এসেছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ৫২ শতাংশ কল বেড়ে গেছে। ফলে সরকারের খুব একটা রাজস্ব ক্ষতি হবে না। আসলে অপারেটররা তো চোর! অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা তো তারা করে। অবৈধ কল বাড়লে তো তাদের লাভ। এই কারণে সরকারের ভালো সিদ্ধান্তও তারা বাঁকা ভাবে দেখে।’
তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কল বাড়লেও সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। পাশাপাশি অ্যামটব বলছে, বিটিআরসির নতুন সিদ্ধান্তের কারণে বৈধ পথে ১০ শতাংশ কল বাড়লেও চারটি মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রতি মাসে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২২৮ কোটি টাকা। ২০ শতাংশ হারে বাড়লেও অপারেটরদের প্রতি মাসে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বছরে যা ২১০ কোটি টাকা।
অ্যামটব মহাসচিব এস এম ফরহাদ ইত্তেফাককে বলেন, কোনো এক ধরনের লাইসেন্সির জন্য তাদের মূল আয়ের বা কল রেটের ওপর রাজস্ব না নিয়ে সর্বনিম্ন রেটের ওপর রাজস্ব ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর। মোবাইল ফোন অপারেটরসহ অন্যান্য আরো যেসব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আছে তাদের ক্ষেত্রেও কি সর্বনিম্ন মূল্য অনুযায়ী রাজস্ব ভাগাভাগি করা হবে? বিটিআরসির নতুন সিদ্ধান্তের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কি দেশে আগের চেয়ে কমমূল্যে কল করার সুযোগ পাবেন? শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের এই নতুন নির্দেশনার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটরদের রাজস্ব আদায়ও কমে যাবে, ফলে তারা ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে অ্যাপভিত্তিক ওটিটি (ওভার দ্যা টপ) কল যেমন হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার প্রভৃতি মাধ্যমে কলের হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। প্রযুক্তি দুনিয়ার ভবিষ্যত্ যাত্রার গতি-প্রকৃতি দেখে বলা যায়, ভবিষ্যতে ওটিটি কল আরো বাড়বে এবং সরাসরি চ্যানেলে কল ক্রমাগত কমবে। ফলে এই সময়ে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট কমিয়ে বৈধ পথে সরাসরি চ্যানেলে ইনকামিং কল বেড়ে যাওয়ার যে প্রত্যাশা বিটিআরসি করছে তা অযৌক্তিক।