চট্টগ্রাম থেকে অপহরণের ১১ দিন পর মায়ের কোলে ফিরলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভ (২৫)। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার বটতলা থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মাইক্রোবাস থেকে কে বা কারা তাকে ফেলে যায়। এ সময় সৌরভের হাত-পা ও চোখ ছিল বাঁধা, পরনে ছিল শুধু পায়জামা।
সৌরভকে ‘দুর্বৃত্তরা’ আটকে রেখেছিল বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার।অপরহণের সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে সৌরভকে জীবিত ফিরে পেয়ে স্বস্তি ফিরেছে পরিবারে। বাসায় ফিরে সৌরভ তাকে উদ্ধারে সহযোগিতা করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তারাকান্দা থানার ওসি মিজানুর রহমান আকন্দ যুগান্তরকে বলেন, ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে সৌরভকে দুই হাত পেছনে ও চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। নিজেই হাত ও চোখের বাঁধন খুলে পাশের জামিল অটোরাইস মিলে যান এবং মিলের ফোরম্যান সমীরের সঙ্গে কথা বলেন।সমীরের মোবাইল ফোন থেকে বাসার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে পরিবার পুলিশকে জানালে পুলিশ সৌরভকে উদ্ধার করে।
জেলা পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কে বা কারা সৌরভকে জামিল অটোরাইস মিলের সামনের রাস্তায় রেখে যায়। সৌরভ রাইস মিলে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে মিলের ফোরম্যান সমীর তার পরিবারকে খবর দেন। তখন পরিবারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হলে ভোর ৫টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের ডিসি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আমাকে ফোনে সৌরভকে পাওয়ার কথা জানান।
পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে বটতলা বাজারে পৌঁছে সৌরভকে উদ্ধার করে নিজের বাংলোয় নিয়ে আসি।পুলিশ সুপার জানান, ‘সৌরভের শারীরিক অবস্থা ভালো এবং সুস্থ আছেন। ওই মুহূর্তে সৌরভের সঙ্গে কথা বলার মতো পরিস্থিতি হয়নি। তাকে রাইস মিলের একটি চেয়ারে বসা অবস্থায় পেয়েছি। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে কিনা বা ১১ দিন কোথায়, কিভাবে ছিলেন জানতে চাইলে পুলিশ সুপার জানান, সৌরভ এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি, বলেছেন পরে কথা বলবেন। তবে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্যারকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি বলেছেন, সৌরভের বাবা-মা খুব উদ্বিগ্ন অবস্থায় রয়েছেন। তাকে আমার বাংলোতে নেয়ার পর তিনি গোসল করেন এবং নতুন জামা পরে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে পরিবারের চাহিদা অনুসারে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। তাকে কারা সেখানে ফেলে গেছে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, এটা তদন্তের বিষয়।
বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় ফেসবুক লাইভে এসে সৌরভের উদ্ধার হওয়ার খবর জানান মামা সোহেল তাজ। বলেন, ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে সৌরভের মায়ের কাছে একটি ফোন আসে। বলা হয়, সৌরভকে রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়া হয়েছে।সোহেল তাজ পরে চট্টগ্রামে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপকমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি কথা বলেন পুলিশ সুপারের সঙ্গে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবারও ফেসবুক লাইভে আসেন সোহেল তাজ। এ সময় তিনি বনানীর বাড়ির সামনে অপেক্ষায় থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সৌরভ কেমন আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সৌরভের কন্ডিশন ভালো ছিল না, যেটা শুনতে পাচ্ছি, ওকে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ওর গায়ে কোনো জামা ছিল না, শুধু পায়জামা ছিল। চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। যদি সৌরভকে মুক্ত করে দেয়া না হয়, তাহলে যারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে, তিনি তাদের নাম বলবেন বলে এর আগে বলেছিলেন।
সৌরভের মুক্তির পর এখন তিনি কী করবেন জানতে চাইলে সোহেল তাজ বলেন, ‘১১ দিন ধরে ছেলেটি নিখোঁজ ছিল। এখন সময় হচ্ছে ফ্যামলির মুখে একটু হাসি দেয়া। এখন এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় নয়। আমরা এখন জাস্ট ছেলেটাকে রিসিভ করতে চাচ্ছি। ওকে একটু স্বস্তি দেয়া। আপনারা বুঝতে পারছেন, ও যেখানেই ছিল শান্তিতে ছিল না। ও অলরেডি আমাকে আভাস-ইংগিত করেছে, ওর কী দুরবস্থা ছিল। আমি ওকে আশ্বস্ত করেছি, ওর ওপর কোনো ধরনের চাপ দেয়া যাবে না, ও মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত। আমরা এ বিষয় নিয়ে এখন আলাপ করব না।
’ সোহেল তাজ ফেসবুক লাইভে থাকতে থাকতেই একটি মাইক্রোবাসে পুলিশি পাহারায় সৌরভকে বনানীর ওই বাসায় নিয়ে আসা হয়। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে মাকে এবং পরে বাবাকে জড়িয়ে ধরেন সৌরভ। এ সময়ই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ দেন। তাকে উদ্ধারে সহযোগিতা করার জন্য তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ধন্যবাদ জানান। মা-বাবা ও মামার সঙ্গে তিনি লিফটে উঠার পর সোহেল তাজের ফেসবুক লাইভ শেষ হয়। এ সময় সোহেল তাজ বলেন, এমনটা যেন আর কোনো পরিবারের সঙ্গে না হয়। আমাদের নিজেদের সঙ্গে এমনটা হয়েছে।
কেউ নিখোঁজ হলে তার পরিবারের ওপর দিয়ে কী অবস্থা যায় আমরা জানি। এ মানসিক যন্ত্রণা কোনো মানুষের কাম্য নয়।তাদের বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম -সৌরভের পিতা : সৌরভের বাবা ইদ্রিস আলম যুগান্তরকে বলেন, ছেলেকে ফিরে পেয়েছি এতেই আমি খুশি। আল্লার কাছে শুকরিয়া যে ছেলেকে জীবিত ফেরত পেয়েছি। ভোর রাতে ময়মনসিংহ এলাকার এক লোক ফোনে বলেন, রাস্তার পাশে একটা লোক পড়ে আছে। সে নাকি আপনার ছেলে। তাকে কে বা কারা ফেলে চলে গেছে।
সৌরভ এখন অসুস্থ। তার ঘুম ঘুম ভাব। সে যেখানে বসছে সেখানেই ঝিমোচ্ছে। যারা নিয়ে গেছে তাদের বিচার কিংবা শাস্তি চান কিনা এমন প্রশ্নে ইদ্রিস আলম বলেন, আগেও বলেছি ছেলেকে ফিরে পেলে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করব না। ছেলেকে জীবিত ফিরে পাওয়ার প্রতীক্ষায় ছিলাম। যারা নিয়ে গেছে তাদের বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম।’
যেভাবে আশ্রয় চায় সৌরভ : জামিল অটোরাইস মিলের ম্যানেজার কাঞ্চন মিয়া ও ফোরম্যান সমীর সাংবাদিকদের জানান, ভোরে বিপর্যস্ত অবস্থায় একজনের ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙে। লোকটি একটু আশ্রয় ও পানি চাচ্ছিল। একপর্যায়ে তাকে বসতে দিয়ে পাশের দোকান থেকে বিস্কুট ও পানি কিনে খেতে দেই। আলাপচারিতায় তাকে ভদ্রঘরের সন্তান বলেই মনে হয়েছে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের ভাগ্নে বলে। এ সময় আমাদের মোবাইল ফোন থেকে ‘সৌরভ’ তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। বিষয়টি মিলের মালিক হিজবুল বাহার খান বাচ্চুকে জানানো হয়।
পরে সৌরভকে মিলের ভেতর নিয়ে চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। সৌরভ মিলের ফোরম্যান সমীরের মোবাইল ফোন থেকে তার বাবার সঙ্গে কথা বলেন। পরে সোহেল তাজও একই নম্বরে ফোন দিয়ে সৌরভের সঙ্গে বলেন। সোহেল তাজ আমাদের বলেন, আমরা যেন পুলিশ ছাড়া কারও কাছে সৌরভকে হস্তান্তর না করি। পরে পুলিশ সুপার এসে সৌরভকে নিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর সৌরভকে ডিবির ওসি শাহ কামাল আকন্দের নেতৃত্বে একটি টিম ঢাকায় নিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, ভোরে একটি মাইক্রোবাস তাকে ময়মনসিংহ শেরপুর সড়কে ফেলে দ্রুত চলে যায়।
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, সৌরভ সুস্থ-স্বাভাবিক হলে তাকে অপহরণের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কারা তাকে কোথায় নিয়ে গেছে এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব। দায়ীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করব। সৌরভ অপহৃত হওয়ার পর তার পিতা ইদ্রিস আলম পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডি করেন।
ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে। ওই ভিডিওতে দেখা যায় অপহরণকারীরা সৌরভকে কৌশলে একটি কালো রঙের ল্যান্ড ক্রুজার জিপে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনার পর সৌরভের স্বজনরা দাবি করেছেন, ‘সৌরভের সঙ্গে সওদা নামে এক মেয়ের সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি মেয়ের ব্যবসায়ী পিতা। এ কারণে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে সৌরভকে তিনি অপহরণ করিয়েছেন। ওই মেয়েকে এবং তার ব্যবসায়ী পিতাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের দাবিও জানানো হয়।’
৯ জুন চট্টগ্রামের মিমি সুপার মার্কেটের আগোরার সামনে থেকে সৌরভ অপহৃত হন। শনিবার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে সোহেল তাজ এমন অভিযোগ করেন। পরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন তিনি। এ সময় সৌরভের মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমান উপস্থিত ছিলেন। সৌরভ ঢাকার ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষে ডকুমেন্টরি তৈরির কাজ করতেন।
|