সিলেট কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের ফ্ল্যাট থেকে ঘুষ-দুর্নীতির ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফ্ল্যাটের বিভিন্ন কক্ষে তোশক, বালিশের কভার এবং আলমিরায় লুকানো অবস্থায় এ টাকা পাওয়া গেছে। রোববার বিকালে নগদ টাকাসহ প্রথমে তাকে আটক ও পরে গ্রেফতার দেখানো হয়।
রাতেই দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ নিজের হেফাজতে রাখার দায়ে এ মামলা হয়। তাকে আজ আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানান তিনি।
দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি টিম রোববার বিকালে পার্থ গোপাল বণিকের গ্রিন রোড সংলগ্ন ভূতের গলির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। এর আগে সকালে চট্টগ্রাম কারাগারের দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পার্থ দুদক টিমের কাছে বক্তব্য দিতে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে হাজির হন।
অবৈধ সম্পদ, ঘুষের টাকা, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেয়া অর্থ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে গত বছর অক্টোবরে ঘুষের ৪৭ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার চট্টগ্রামের জেলার সোহেল রানার দেয়া কিছু তথ্য সম্পর্কে তার কাছে জানতে চায় দুদক টিম।
সোহেল রানা গ্রেফতারের পর বলেছিলেন, তিনি পার্থ গোপাল বণিককেও ঘুষের বেশ কয়েক লাখ টাকা দিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে পার্থর কাছে দুদকের কর্মকর্তারা জানতে চান, আপনি ঘুষের এত টাকা কী করেছেন?
দুদক কর্মকর্তারা সোহেল রানার দেয়া তথ্য ছাড়াও আরও কিছু প্রমাণ সামনে তুলে ধরে তার কাছে জবাব চান। এ সময় পার্থ নিজেকে আড়াল করে বক্তব্য দেয়ার চেষ্টা করেন। জেরার একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, রাজধানীর গ্রিন রোড সংলগ্ন তার নিজের ফ্ল্যাটে ৫০ লাখ টাকা রেখেছেন।
বাসায় এত টাকা কেন রেখেছেন- এমন প্রশ্নে তিনি অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেন, এফডিআর করার জন্য রেখেছি। দুদক কর্মকর্তারা জানতে চান- এ টাকার উৎস কী? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পার্থ বণিক। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী দুদকের ওই অনুসন্ধান টিম তাকে নিয়ে রাজধানীর ২৭/২৮/১, নর্থ গ্রিন রোড (ভূতের গলি) তার ফ্ল্যাটে যায়।
যাওয়ার পর তার ঘরের আলমিরা, তোশক, ওয়ারড্রোবসহ বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি করে লুকানো অবস্থায় ৮০ লাখ টাকা পায়। এই টাকা খুঁজে বের করতে কর্মকর্তাদের এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। টাকা উদ্ধারের পর তা গুনতে লেগেছে আরও এক ঘণ্টা। কিছু টাকা তিনি বালিশের কভারের ভেতরও রেখেছিলেন।
জানা গেছে, দুদক টিম যখন পার্থ বণিককে নিয়ে তার নর্থ রোডের বাসায় যায় তখন তার স্ত্রী রতন মনি সাহা তাদের বাসায় ঢুকতে বাধা দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা তিনি দরজা আটকে রাখেন। পরে তারা দরজা ভেঙে ঢোকার কথা জানালে দরজা খুলে দেয়া হয়। এরই মধ্যে পার্থর স্ত্রী বেশ কিছু টাকা বাজারের ব্যাগে ভরে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ফেলে দেন।
পরে দুদকের টিমের সদস্যরা ওই ছাদ থেকে টাকার ব্যাগটি উদ্ধার করেন। বিকাল ৪টায় শুরু হয় এ অভিযান। তবে রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত টিমের সদস্যরা ওই বাসায় অবস্থান করছিলেন। কারণ উদ্ধার হওয়া ৮০ লাখ টাকা জব্দ করার পর প্রতিটি নোটের নম্বর রেজিস্টারে লিখে নেন দুদকের সদস্যরা।
এ কারণে রাতে মামলাটি করতে সময় নিতে হয় বলে জানান টিমের একজন সদস্য। মামলায় পার্থ বণিকের সঙ্গে তার স্ত্রী রতন মনি সাহাকেও আসামি করা হতে পারে। কারণ তিনি ওই অবৈধ টাকা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি টাকাগুলো এখানে-ওখানে লুকিয়ে রেখে দুদকের কাজে অসহযোগিতা করেছেন।
তার বাড়িতে কালো রঙের একটি দামি গাড়ি পাওয়া গেছে। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে পার্থ বণিক জানিয়েছেন, গাড়িটি তার এক বন্ধুর কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন। তিনি ডমইনোর ৭ তলায় ২০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে থাকেন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। তিনি এই গাড়ি এবং ফ্ল্যাটের তথ্য তার আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি।
দুদক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। টাকাগুলো জব্দ করার পর তাকে দফায় দফায় ওই বাসায়ই জেরা করেন দুদকের কর্মকর্তারা। এমনকি তার স্ত্রী রতন মনি সাহাও জেরার মুখে পড়েন। এ সময় পার্থ বণিক দুদক কর্মকর্তাদের জানান, তিনি তার আয়কর নথিতে ৪০ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন।
ওই ৪০ লাখ টাকার সম্পদ যে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে, এর বাইরে। ওই ৪০ লাখ টাকার সম্পদও তিনি কীভাবে তার আয়কর নথিতে দেখালেন তারও কোনো সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি। দুদকের অভিযান টিমের প্রধান পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ রাতে যুগান্তরকে বলেন, পার্থ বণিককে যখন আমরা দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম তখন তিনি একেক সময় একেক রকম তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেন।
আমাদের কাছে গোপন সূত্রে খবর ছিল, ডিআইজি পার্থ বণিক প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে কয়েক লাখ টাকা করে ঘুষ পান। তাকে তথ্য-প্রমাণসহ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, আমার বাসায় নগদ ২০ লাখ টাকা আছে। পরে বলেন, ৩০ লাখ টাকা আছে। আমরা তার কথা বিশ্বাস করিনি।
তাকে বলেছি, সত্যি করে বলেন, পরে তিনি বলেন, ৫০ লাখ টাকা আছে। কিন্তু আমরা সরাসরি তার ফ্ল্যাটে এসে ৮০ লাখ টাকা পেলাম। এই টাকা লুকানোর জন্য পার্থ বণিক ও তার স্ত্রী অনেক ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার বাসায় এত বিপুল পরিমাণ অর্থ রাখার ঘটনা নজিরবিহীন।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার সহযোগী কর্মকর্তাদের নামও বের করা হবে। দুদক কর্মকর্তাদের ধারণা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা এ অর্থ বাসায় রেখেছিলেন ডিআইজি প্রিজন পার্থ।
ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক ২০০২ সালের ২০ জুন জেল সুপার হিসেবে যোগদান করেন। প্রথমে তার পোস্টিং হয় রংপুর। ২০১৪ সালে ডিআইজি (প্রিজন) হিসেবে পদোন্নতি পান। পরে তাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে সিলেট বদলি করা হয়।
২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতারের পর আলোচনায় আসেন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক। ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক এবং ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ রেলওয়ে পুলিশ সোহেল রানাকে গ্রেফতার করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন।
চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলার সোহেল রানা গ্রেফতারের পর ‘ঘুষের ভাগ পার্থ বণিককে দিয়েছেন’- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিককে সিলেটে বদলি করা হয়। সোহেল রানার ঘুষের অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির খোঁজ পায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে কয়েক কর্মকর্তা একাধিকবার দুর্নীতির দায়ে বিভাগীয় শাস্তি ভোগ করেছেন- এ ধরনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।
সে সময় সোহেল রানার বিরুদ্ধে তদন্তের পাশাপাশি ডিআইজি পার্থ বণিকসহ বেশকিছু কারা কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দুদক থেকে ওই কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ ও ঘুষ-দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয়।
অনুসন্ধানকালে দুদক নানা মাধ্যম থেকে সোহেল রানা ছাড়াও অন্তত ৫০ কর্মকর্তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিমের কাছ থেকেও দুদক কিছু তথ্য পায়। তাতে কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের নাম রয়েছে বলে জানা যায়। এ ছাড়া দু’জন সিনিয়র জেল সুপার, ৭ জন ডেপুটি জেলারসহ ৪৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য দুদকের হাতে আসে।
পার্থ ও সোহেলের মধ্যে অবৈধ অর্থ লেনদেনের বিষয়ে কিছু তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মনিরুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে পাওয়া গেছে। সোহেল রানার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষের তৎকালীন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক এবং বর্তমানে বরিশালের (তৎকালীন চট্টগ্রামের) সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিককে ঢাকায় হস্তান্তরের কথা ছিল।
গত ২ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে জেলার সম্মেলনে এই কর্মকর্তাদের আসার কথা ছিল। সরকারি তদন্ত কমিটি বিভিন্ন অনিয়মের জন্য দায়ী করে সোহেল রানার পাশাপাশি পার্থ গোপাল বণিক ও প্রশান্ত কুমার বণিকের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য দুদকের কাছে সুপারিশ করে।
দুদক সূত্র বলছে, এবারের অনুসন্ধানে কারা কর্তৃপক্ষের অনেক কর্মকর্তাই ফেঁসে যাবেন। শুধু চট্টগ্রামই নয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের অন্যান্য কারাগারের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
|