আশরাফুল আলম তানোর রাজশাহী প্রতিনিধি: উত্তর বঙ্গের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি আলু চাষ হয় রাজশাহীর তানোরে। চলতি মৌসুমে আলু চাষের জন্য বীজ আলু নিয়ে শুরু হয়েছে মহা সিন্ডিকেট। এসিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও নেতারা। যার কারনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারছেনা বলেও একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেন। ব্র্যাকের বীজ আলু পেতে গুনতে হচ্ছে দ্বিগুন টাকা। তারপরও মিলছে না ব্র্যাকের বীজ। শুধু আলু বীজ না সার নিয়েও শুরু হয়েছে লংকাকান্ড। জানা গেছে, উপজেলার প্রায় প্রতিটি মাঠে রোপা আমন ধান কাটা শেষ হয়েছে। শেষ হওয়া মাত্রই আলু রোপনের জন্য জমি চাষ চলছে। কিন্তু ব্র্যাক আলুর বীজ কোনভাবেই কৃষকরা পাচ্ছে না। সম্প্রতি তালন্দ বাজারে ব্র্যাক আলুর বীজ ডিলার শাহিনের দোকানে বীজ পেতে ভোর রাত থেকে লাইনে দাড়িয়ে বিকেলের দিকে এক বস্তা করে বীজ ন্যায্য মূল্যে কিনতে পারেন। সেটা একেবারে অপ্রতুল। ব্র্যাক আলুর বীজ ডিলার শাহিন। তার মোকাম তালন্দ বাজারে। সে গোকুল মাদ্রাসার শিক্ষক। শাহিন ব্র্যাক বীজ নিয়ে মহা কারসাজি করেছেন বলে অহরহ অভিযোগ। রাতের আধারে দ্বিগুণ দামে প্রান্তিক চাষীদের কাছে বিক্রি না করে ট্রাকের ট্রাক বীজ কালোবাজারি করেছেন। গত মঙ্গলবার শীতের সকালে ট্রাকে করে সরনজাই ইউপির দিকে পাচার করেন তার ভাই। শাহিনের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমে অস্বীকার করলে পরে বলেন আমি অসুস্থ পরে কথা বলছি। পরে মোবাইল বন্ধ রাখেন তিনি। এমনকি ব্র্যাকের বীজ রিপ্যাক ও কালোবাজারে বিক্রি করছে। গত বছর তার কাছে থেকে ব্র্যাকের রিপ্যাক করা আলু বীজ কিনে অনেক আলুচাষি ক্ষতির মুখে পড়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার গোকুল মাদ্রাসায় গিয়ে শাহিন মাস্টারের খোজ করা হলে সুপার আব্দুল হামিদ জানান অসুস্থতার কারন দেখিয়ে চার দিনের ছুটি নিয়েছেন। সে নাকি গত প্রায় ৮/১০ দিন ধরে অনুপস্থিত এবং হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যান জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। কৃষকদের ভাষ্য, শাহিন মাস্টার ব্র্যাকের বীজ ডিলার হয়ে প্রতি নিয়তই রাতের আধারে বীজ পাচার করেছে। কারন ব্র্যাকের বীজ ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু ৭/৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সে গত প্রায় ১০/১২ দিন ধরে বিভিন্ন তালবাহানায় আত্মগোপনে আছে। বন্ধ রয়েছে তার মোবাইল নম্বর। তালন্দ এলাকার আলু চাষি সোহেল জানান, তিন বিঘা জমিতে আলু চাষ করব। কিন্তু একবস্তাও বীজ মিলেনি। তিনি আরো জানান হাফিজুর ৭ বিঘা জমির জন্য বীজ পায়নি। ইসারুল ইসলাম ৬ বিঘা জমিতে, সলিম ৫ বিঘা জমিতে আশরাফুল ৩ বিঘা জমির জন্য বীজ পায় নি। শুধু বীজ না সারও মিলছে না সঠিক দামে। কামারগাঁ ইউপির ছাঐড় গ্রামের আব্দুল্লাহ জানান, ৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করব। কিন্তু গত প্রায় সপ্তাহ ধরে খোজ করে এক বস্তাও বীজ কিনতে পারেনি। শুধু আমি না আমার ভাই আইয়ুব ৫ বিঘা, নমির ৩ বিঘা, এমদাদুল আড়াই বিঘা, বিপুল ৬ বিঘা, মোহাম্মাদ আলীপুর গ্রামের সামিউল ৫ বিঘা, মোকলেসুর ২ বিঘা, মান্নান ২ বিঘা,সাফিউল দেড় বিঘা, হাতিনান্দা গ্রামের তমিজ ১০ বিঘা জমির জন্য তীল পরিমান বীজ পায়নি। তারা জানান, আমরা বীজ না পেলেও প্রতিনিয়তই দ্বিগুণ দামে বীজ কিনছেন মৌসুমী চাষিরা। আমরা অল্প পরিমানে নিজস্ব জমিতে আলুর চাষ করব এজন্য আমাদের মত প্রান্তিক কৃষকদের বীজ দেয়া হচ্ছে না। কারন দ্বিগুণ দাম তো দিতে পারব না। শুধু বীজ না সার পাওয়ায় কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ন্যায্য দামে কোন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো বা আলু চাষ করতে পারব কিনা সন্দেহাতীত। গত মঙ্গলবার তানোরে আসেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) আফিয়া আখতার। তিনি উপজেলা সম্মেলন কক্ষে রাজনৈতিক নেতা ও সুধীজনদের সাথে মতবিনিময় করেন। সেখানে আলুর বীজ ও সার নিয়ে মহা কারসাজির বিষয়ে ডিসিকে অবহিত করা হয়। সার বীজ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহম্মেদের নিকট জানতে চান ডিসি। কৃষি অফিসার দায়সারা অফিসিয়াল বক্তব্য দিয়ে মুক্ত হন। তার বক্তব্যে কোন সমাধান ছিল না। কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি অফিসের মাঠ কর্মী বা বিএস রয়েছে। তাদের তো হিসেব থাকার কথা কোন এলাকায় কত কৃষক আলু রোপন করবেন। আলু রোপনের জন্য কতটুকু বীজ সারের প্রয়োজন। কিন্তু বিএস`রা মাঠে না এসে ঘরে বসেই হিসেব করে থাকে। যার কারনে প্রতি বছর আলু রোপনের আগে চলে সিন্ডিকেট। আলু রোপনের জন্য কতটুকু বীজ কৃষকদের ঘরে মজুদ আছে এবং কি পরিমান আমদানি করতে হবে। এসব নিয়ে কাজ করলে কেউ সিন্ডিকেট করতে পারবে না। সেটা না করে কৃষি অফিস থেকেই বলা হচ্ছে বাহির থেকে সার আনতে হবে, নইলে ঘাটতি পুরুন হবে না। এজন্য সার কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। বিসিআইসি থেকে শুরু করে বিএডিসি ডিলারদের একটাই কথা কৃষি অফিসের অনুমতিতে বাড়তি দামে কিনে এনেছি, বাড়তি দামে বিক্রি করতে হবে। চাইলে নাও, না চাইলে চলে যাও। প্রতিনিয়তই পার্শ্ববর্তী উপজেলা মোহনপুর কেশরহাট, ধুরইল বাজার, মান্দা উপজেলার, সাবাইহাট, দেলুয়াবাড়ি, চৌবাড়িয়া সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাই পথে সার আনছেন ছোট বড় ব্যবসায়ীরা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রতি আলু মৌসুমে তারা কারসাজি করতে এক হয়ে যান। এসব এলাকা থেকে ব্র্যাকের আলুর বীজ আসছে প্রতিনিয়তই। আমরা মনে করেছিলাম স্বৈরাচার হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছে, দেশে কোন সিন্ডিকেট হবে না। কিন্তু বাস্তবে এর পুরোটাই বিপরীত। এবছর যে পরিমান সিন্ডিকেট হয়েছে বিগত বছরে এপরিমান সিন্ডিকেট হয়নি। বীজের সিন্ডিকেটের কারনে অনেকেই খাওয়ার আলু রিপ্যাক করে বিক্রি করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের ফুঁসিয়ে তুলতে কৃষকদের বীজ সার নিয়ে মহা কারসাজি করছেন দোসর"রা। কারন স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও দোসর"রা বহাল তবিয়তে থেকে সিন্ডিকেট করছেন। বীজ আলু সিন্ডিকেট হচ্ছে, তালন্দ, কাশিম বাজার, কালীগঞ্জ, থানা মোড়, চৌবাড়িয়া, কেশরহাট, ধূরইল, সাবাইহাটসহ বিভিন্ন এলাকার ক্ষুদ্র মাঝারি সার কীটনাশক ব্যবাসীরা কারসাজি করছেন। উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহম্মেদ জানান, এবার উপজেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। এজমি রোপনের জন্য বীজের প্রয়োজন ২৯ হাজার ৫১০ মে:টন। তবে কি পরিমান বীজ মজুদ আছে এবং কি পরিমান আমদানি করতে হবে জানতে চাইলে কোন সদ উত্তর দিতে পারেন নি। ডিলার সম্পর্কেও তেমন কোন তথ্য নেই কৃষি অফিসে। অবশ্য সবকিছু দ্রুত সময়ের মধ্যে কেটে যাবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে আশাবাদী তিনি।