আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয়তম হাবিবের উম্মতদের জন্য বিশেষ কিছু রাত উপহার হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, যে রাতগুলো অন্যান্য রাতের মতো সাধারণ নয়। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর হাবিবের ঘোষণা অনুসারে এ রাত হয়ে উঠেছে অসাধারণ। হাদিসের মধ্যে অসাধারণ মর্যাদাসম্পন্ন যে পাঁচটি রাতের কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম একটি ‘শবে কদর’। ‘অন্যতম’ এই অর্থে যে, এ রাতের মর্যাদা-ফজিলত সম্পর্কে ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়কে উপলক্ষ করে যত দল-মত রয়েছে সকলেই বিনা বাক্যে এ রাতের মর্যাদার আলোচনায় একমত পোষণ করেন। ‘শব’ শব্দটি ফারসি। এর অর্থ রাত আর ‘কদর’ শব্দটি নিয়েছি সরাসরি কুরআন থেকে, যার অর্থ সম্মান। পারিভাষিক অর্থে ‘শবে কদর’ মানে, সম্মানিত রাত, মর্যাদাসম্পন্ন রজনী। অর্থাৎ, এ রাতকে আল্লাহ তায়ালা সম্মানিত করেছেন, মর্যাদার মাধ্যমে অনন্য করেছেন।
সূরা বাকারায় রমজানের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রমজান এমন একটি মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে”। (বাকারা : ১৮৫) প্রশ্ন হলো, কুরআন কি আল্লাহ তায়ালা পুরো রমজান জুড়ে নাযিল করেছেন না নির্দিষ্ট কোনো রাতে? সূরা কদরের মধ্যে এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর বিদ্যমান। কদরের প্রথম আয়াত: “নিশ্চয়ই আমি এটিকে নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আর কুরআন নাযিলের কারণেই আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের মর্যাদা এতো বাড়িয়েছেন। এখন কোন রাতকে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর হিসেবে গণ্য করা হয়?
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা রমজানের শেষ-দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করো। (বুখারী : ২০২০) শেষ-দশক মানে কি প্রতিদিন তালাশ করতে হবে? রাহমাতুল্লিল আলামীন নবী আমাদের জন্য আরও সহজ করেছেন এভাবে, তোমরা রমজানের শেষ-দশকের বেজোড় রাত সমূহে লাইলাতুল কদর তালাশ করো। (বুখারী : ২০১৭)অর্থাৎ, ২১-২৩-২৫-২৭-২৯ এ পাঁচটি রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের তালাশ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। এখানে ‘তালাশ’ মানে হচ্ছে, ইবাদতের মাধ্যমে এ মহিমান্বিত রজনীর সদ্ব্যবহার করা, অফার লুফে
নেওয়া। আমাদেরকে যদি শবে কদরের বরকত হাসিল করতে হয় বিশেষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয় তাহলে অবশ্যই রমজানের শেষ-দশকের পাঁচটি বেজোড় রাত্রিতে একনিষ্ঠতার সহিত ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২৭ রমজান যেভাবে আমরা মুসলমানগণ আনুষ্ঠানিক ভাবে শবে কদর পালন করে থাকি তার ভিত্তি কী? দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের পেরেশানী লঘু করার জন্য এ রাতের ব্যাপারে আরও নির্দিষ্ট করে বলছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অক্ষম হয় বা দুর্বল থাকে তাহলে সে যেন ২৭ রমজানের রজনীকে লাইলাতুল কদর বলে বিবেচনা করে ইবাদত করে”। (মুসলিম : ১১৬৫) হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ২৭ রমজানকে লাইলাতুল কদর বিবেচনা করে ইবাদত করতে বলেছেন”। অতএব, হাদিসের ভাষ্যানুসারে ২৭ রমজান যেহেতু লাইলাতুল কদর বা শবে কদর হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি সেজন্যই আমরা ২৭ রমজান রজনীতে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকি। যে রাতে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর হবে তার আরও কয়েকটি আলামত হাদিস শরীফে এসেছে:
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
১. আকাশ মেঘমুক্ত ও উজ্জ্বল থাকবে। (তিরমিযি) ২. ঠাণ্ডা ও গরমের মাঝামাঝি তথা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া থাকবে। (তিরমিযি) ৩. রাতগত দিনে সূর্য উদিত হবে আলোক-রশ্মীহীন অবস্থায়, অর্থাৎ সূর্যের চিরচেনা তেজবিহীন অবস্থায়। (মুসলিম, সহিহ ইবনে খুযায়মা)
এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গেলে সর্ব প্রথম বলতে হয় সূরা কদরের কথা। যে সূরাতে শবে কদরের মর্যাদা খুঁজে পেতে একটুও বেগ পেতে হয়না। করুণাময় প্রভু এ রাতের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, “লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম”। এ পরিচয়ের পর আরও বিস্তৃত বর্ণনায় আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “এ রাতে ফেরেশতারা এবং জিবরাইল তাঁদের রবের অনুমতি ক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে (পৃথিবীতে) অবতরণ করে ; আর ফজরের সময়কাল পর্যন্ত এ শান্তিপূর্ণ রজনীর দৈর্ঘ্য”। সূরা কদর যতবার পড়া হয় এ রাতের মর্যাদা যেন তত অন্তরঙ্গ-আলোয় উপলব্ধি হয়। যে রাত ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ সে রাতকে ইবাদত-বন্দেগীতে পূর্ণ করাই যেন তাঁর প্রতি আমাদের যথার্থ সম্মানের বহিঃপ্রকাশ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে নফল নামায আদায় করবে, ইবাদত করবে তার পূর্বের সমস্ত সগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে”। (বুখারী : ১৯০১) ইবনে মাজাহ নামক হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে, প্রিয় নবী সাবধান করে দিয়ে বলেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর থেকে বঞ্চিত হলো সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিতহলো”।আবু দাউদ নামক হাদিস গ্রন্থে রয়েছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করতে পারলোনা তার মতো হতভাগা-বদ নসিব আর কেউ নেই”। আম্মাজান হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি যদি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাই তাহলে কোন দোয়া পড়বো?”নবীজি বললেন, “তুমি পড়বে আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি ইয়া গাফুর”, অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, আমাকেও ক্ষমা করুন। (তিরমিযি : ৩৫১)
এ রাত যেহেতু কুরআন নাযিলের কারণে মর্যাদা সম্পন্ন হয়েছে তাই এ রাতে আমাদের নামায, জিকির, তাসবিহ ইত্যাদির পাশাপাশি কুরআন তেলাওয়াত করাও উচিত হবে। হাজার মাসের ইবাদত একরাতে সম্পন্ন করার যে দুর্লভ সুযোগ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দান করেছেন তার সদ্ব্যবহার করতে লাইলাতুল কদর বা শবে কদরে সারা রাত ব্যাপী ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পবিত্র শবে কদরের পূর্ণ বরকত হাসিল করার তৌফিক দান করুক, আমিন।