মুসাফাহা অর্থ করমর্দন, হাতে হাত মেলানো। আগন্তুক অথবা সাক্ষাতকারীর হাত ধরে তাকে অভিনন্দন জানানোর নাম মুসাফাহা।
এটা সালামের পূর্ণতা সাধন করে। কারও সাক্ষাত হলে মুখে সালাম আদান-প্রদান করে হাতে হাত মিলানো মুসলিম ঐতিহ্য ও সামাজিকতার অংশ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। সাহাবাদের রীতি-রেওয়াজ। এ বিষয়ে হজরত কাতাদাহ বলেন, আমি হজরত আনাস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, সাহাবাদের আমলে কি তাদের মধ্যে মুসাফাহার প্রচলন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। -সহিহ বোখারি : ৬২৬৩
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন, রোগী দেখতে যাওয়ার কাজ পূর্ণ হয় রোগীর কপালে বা হাতে হাত রেখে এ কথা জিজ্ঞাসা করলে, আপনার অবস্থা কেমন? আর অভিনন্দন জানানো পূর্ণ হয় মুসাফাহা করলে। -মিশকাত : ৪৬৮১
মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। মানুষের বন্ধন সুদৃঢ় হয় সুন্দর আচরণের মাধ্যমে। তাই সুন্দর আচার-ব্যবহার প্রকাশের প্রতিটি ধরণ আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয়। কারও সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সালাম আদান-প্রদানে সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দিলে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও বিনয় প্রকাশ পায়। পরস্পরে এমন ভালোবাসার দৃশ্য আল্লাহতায়ালার কাছে অনেক পছন্দনীয়। আল্লাহ খুশি হয়ে পুরষ্কার প্রদান করেন। কাজ যদিও ছোট কিন্তু পুরষ্কার দিচ্ছেন আল্লাহ। তাই কাজের বিবেচনায় পুরষ্কার ছোট হবে না। বরং দাতার বিবেচনায় তা বড়ই হবে। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুজন মুসলিম যদি সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করে তবে তারা আলাদা হওয়ার আগেই আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন। -সুনানে আবু দাউদ : ৫২১৪
তবে আবু দাউদের ৫২১৩ নং হাদিসে মুসাফাহা দ্বারা মাগফিরাত ও ক্ষমা লাভের জন্য মুসাফাহা করার সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। হাদিসের এ নির্দেশনার কারণে আলেমরা বলেন, মুসাফাহা করার সময় এভাবে দোয়া করা সুন্নত- ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম।
হজরত হুযাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এক মুমিন যখন আরেক মুমিনের সঙ্গে দেখা করতে যেয়ে সালাম দেয় এবং তার হাতে ধরে মুসাফাহা করে তখন তার গুনাহগুলো সেভাবে ঝরে পড়ে যেভাবে শীতকালে গাছের পাতাগুলো ঝরেপড়ে। -আওসাত লিত তাবারানি : ২৪৫
সালামের পর দুই হাতে করমর্দন করে অভিনন্দন জানানো মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামি রীতি। সহিহ বোখারির বর্ণনা মতে, হাম্মাদ বিন যায়দ আবদুল্লাহ ইবনে মোবারকের সঙ্গে মুসাফাহা করেছিলেন দুহাতে।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে তাশাহহুদ শেখান তখন তার হাত ছিল রাসূলের দুই হাতের মাঝে। এগুলো থেকে বুঝা যায় মুসাফাহা দুই হাতে হবে। মুসাফাহার পর হাত নিয়ে বুকে রাখার কোন দলিল হাদিসে পাওয়া যায় না। তাই তা পরিত্যাজ্য।
সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে, আচার ও আচরণে বিজাতীয় রীতি রেওয়াজ অনুসরণ করাকে ইসলাম কঠোরভাবে ঘৃণা করে। তাই করমর্দনের এমন কোনো রীতি বা পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিৎ হবে না- যা অতীতের কোনো অলি-আউলিয়া ও আলেম-উলামাদের থেকে আমরা পরম্পরায় পাই নাই বা দেখি নাই।
কাজের ব্যস্ততার কারণে বা অন্য কোনো কারণে যদি মুসাফাহা কষ্টের কারণ হয়- তবে তা বর্জন করাই শ্রেয়। কেননা, মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। সুন্নত আদায় করতে যেয়ে হারামে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি নেই। পরপুরুষের সঙ্গে পরনারীর করমর্দন হারাম। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কারও মাথায় লোহার সূচ বিদ্ধ করা- পরনারী স্পর্শ করার চেয়ে অনেক শ্রেয়। কানজুল উম্মাল : ১৩০৬৫
সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা সুন্নত। বিদায়ের সময়ও মুসাফাহা হতে পারে। মুসাফাহা সালামের পরিপূরক। তাই মুসাফাহা করবে সালামের পর। উভয় হাতে মুসাফাহা করা সুন্নত। এক হাতে মুসাফাহা করা কিংবা হ্যান্ডশেক করা সুন্নত পরিপন্থী ও বিজাতীয় অনুকরণ। তাই এটি পরিত্যাজ্য। তবে অনন্যোপায় অবস্থায় এক হাতে করা যেতে পারে।
মুসাফাহা খালি হাতে করা সুন্নত। মুসাফাহার পর হাতে চুমু খাওয়া, হাত বুকে লাগানো বেদয়াত। তাই এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। কোনো মজলিশ বা বৈঠকে যেয়ে সবার সঙ্গে একাধারে মুসাফাহা করে মজলিসের বিঘ্নতা ঘটানো অনুচিত। একজনের সঙ্গে কিংবা যার উদ্দেশে গেছে তার সঙ্গে মুসাফাহা করেই ক্ষান্ত হবে। মুসাফাহা করতে গিয়ে কাউকে কষ্ট দেওয়া অনুচিত; কারণ মুসাফাহা করা সুন্নত আর কাউকে কষ্ট দেওয়া হারাম। তাই যেসব ক্ষেত্রে মুসাফাহা করতে গেলে যার সঙ্গে মুসাফাহা করা হবে সে বা অন্য কেউ কষ্টের শিকার হয়, সেসব ক্ষেত্রে মুসাফাহা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেসব অবস্থায় সালাম দেওয়া নিষেধ, সেসব অবস্থায় মুসাফাহা করাও নিষেধ। মুসাফাহার আরেকটি আদব হলো, প্রথমে হাত না সরানো।