মাসুম হাসান 

প্রকৃতপক্ষে শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর প্রত্যেক অঞ্চলেই দূরত্বভিত্তিক ভাষাগত পার্থক্য তৈরি হয়৷ কিন্তু কেন?

ভাষার একটি সাধারণ নিয়ম আছে। প্রতি কয়েক কিলোমিটার (আনুমানিক ২০ কিলোমিটার) পরপর আপনি ভাষার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখতে পাবেন।

সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার ভাষা ভিন্ন ভিন্ন - যেমন ঢাকাইয়া, চাটগাইয়া, সিলেটি, খুলনা, বরিশাইল্যা, উত্তরবঙ্গ ইত্যাদি। এই ভাষাগুলোর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন রয়েছে। এছাড়াও, আসলে জেলাভিত্তিক ভাষাগুলোর মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। 

এই পার্থক্যগুলো হয়ে থাকে শব্দচয়ন এবং/অথবা উচ্চারণভঙ্গি। এছাড়াও ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ধরনের আলো, বাতাস, মাটি ও জলের প্রভাবে মানুষের শব্দ উচ্চারণের শারীরিক সক্ষমতা এবং একই প্রভাবে জিনিসপত্রের সহজলভ্যতার জন্যও ভাষাগত পার্থক্য দেখা যায়৷ 

তবে আপনি যদি ভৌগলিকভাবে দূরে অবস্থিত এবং ভাষাগত পার্থক্য থাকা দুটি অঞ্চলের মধ্যকার ভাষার বিবর্তনটি দেখতে চান তবে আপনাকে প্রথম অঞ্চল থেকে দ্বিতীয় অঞ্চলের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে এবং সেখানকার মানুষের ভাষার দিকে মনোযোগী হতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফে যাবেন। আপনি ঢাকা থেকে বের হয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে দাউদকান্দি অঞ্চলে গেলে কুমিল্লা জেলায় পৌঁছে যাবেন এবং সেখানকার লোকজনের ভাষার মধ্যে বিশেষ ধরনের উচ্চারণভঙ্গি বা টান লক্ষ্য করবেন। কিন্তু এই টানটি আনুমানিক ২০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে গেলে উধাও হয়ে যাবে। তারপর আপনি যদি আরও ২৫-৩০ কিলোমিটার এগিয়ে কুমিল্লা শহরের দিকে এগিয়ে যান, তখন দেখবেন আরেক ধরনের উচ্চারণভঙ্গি, যা পূর্ববর্তী অঞ্চলগুলোর উচ্চারণভঙ্গি থেকে একদমই আলাদা। তারপর, আপনি যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দিকে এগিয়ে যান, তবে সম্পূর্ণ পৃথক এক উচ্চারণ দেখতে পারবেন, যা নোয়াখালীর ভাষার উচ্চারণের সাথে অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারপর আপনি ফেনিতে পৌঁছে গেলে নোয়াখালীর ভাষার পুরো আমেজ পাবেন। আরেকটু এগিয়ে যদি আপনি মিরেরসরাইয়ে পৌঁছে যান, তবে পাবেন ভাষার আরেকটি মিলিত রূপ। তা হলো না নোয়াখালী না চাটগাইয়া, মাঝামাঝি এক ধরনের ভাষা। এই অবস্থা পরিলক্ষিত হবে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত। সীতাকুণ্ডের পর থেকেই নোয়াখালী ভাষা অনুপস্থিত হবে এবং আপনি চাটগাইয়া ভাষায় ঢুকে যাবেন। তারপর যতই চট্টগ্রাম অঞ্চলের দিকে ঢুকবেন ততই চাটগাইয়া ভাষার বিভিন্ন ধরনের সাথে পরিচিত হতে শুরু করবেন। আপনি যদি অন্য জেলার মানুষ হয়ে থাকেন এবং চট্টগ্রামের ভাষা সম্পর্কে কোনো ধারনা না থাকে বা সামান্য ধারনা থাকে, তবে এই পর্যায়ে কক্সবাজারে গেলেও আপনার মনে হবে আপনি চাটগাইয়া ভাষায় শুনছেন। তবে আদতে চাটগাইয়া ও কক্সবাজারের ভাষার মধ্যেও বেশ ভালো পার্থক্য রয়েছে। আর আপনি যদি টেকনাফ অঞ্চলে যান, তবে সেখানকার ভাষার সাথে চট্টগ্রামের ভাষার ব্যাপক পার্থক্য বুঝতে পারবেন। তা শব্দচয়ন ও উচ্চারণগত যা `রোহিঙ্গা` ভাষার সাথেই ব্যাপক সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই পর্যায়ে আপনি যদি হঠাৎ করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার বা টেকনাফে চলে যান, তবে দেখবেন সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষা, যা একই দেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে থাকার কারণে উপভাষা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আপনি যদি টেকনাফ থেকে শুধু নাফ নদী পার হয়ে মায়ানমারে ঢুকেন, তবে একই ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হলেও, সেই ভাষাটি একটি আলাদা নামে পরিচিতি পাবে, যার নাম `রোহিঙ্গা` ভাষা।

ঠিক একইভাবে আগরতলার বাংলা ভাষার সাথে কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক মিল রয়েছে। সিলেটি ভাষার সাথে ভারতের করিমগঞ্জের ভাষার মিলও অনুরূপ।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভাষার সাথে ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন অঞ্চলগুলোর ভাষাগুলোরও অনুরূপ মিল রয়েছে। আপনারা হয়ত ভূজপূরি ভাষার নাম শুনেছেন। তার সাথে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর ভাষাগুলোর মিল রয়েছে, যদিও এই ভাষাটির নাম ভিন্ন এবং লেখার বর্ণমালাও ভিন্ন (সম্ভবত হিন্দি বর্ণমালা)। এখানকার মানুষ বাংলাদেশের ভাষা সহজেই আয়ত্ব করে পারেন।

তদ্রুপ, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর (খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা) ভাষার সাথে ভারতের কোলকাতার ভাষার সাদৃশ্য অনেক বেশি।

এই কারণেই আমরা হয়ত বাংলা, হিন্দি, উর্দু, নেপালি ভাষার মধ্যে শব্দগত অনেক মিল দেখতে পাই। যার আদি উৎস একই, শুধু দূরত্বের কারণে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে এবং কালক্রমে ভৌগলিক সীমারেখার কারণে নতুন নতুন নাম ধারণ করেছে।

মূলত, ভাষার বিবর্তন হয় ছোট ছোট অঞ্চলভেদে। কিন্তু ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এবং স্বীকৃতি পায় সেসকল স্থানের মধ্যকার দূরত্ব বেশি হলে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক নতুন বাজার ৭১.কম

 তথ্যসূত্র:  অন্তর্জাল