
মাসুম হাসান
অনেক শব্দ ইমেজ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, শব্দটি শুনলে বা পড়লে তার একটা ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে। “লিডার” তেমনি এক শব্দ যেটি শুনলেই এদেশের মানুষ কতিপয় রাজনৈতিক নেতার মুখ দেখতে পান। এতে কেউ কেউ আনন্দ পান আবার কেউ কেউ ঘৃনা এবং ক্ষোভে শব্দটিকে আর ইমেজ হিসেবে দেখতেই চান না বরং পরের শব্দে মনোনিবেশ করেন।
তবে লিডার শব্দটির সমান্তরাল ইমেজ কিন্তু এরকম নয়। এত ক্ষুদ্র অর্থে নয়। তাহলে প্রশ্ন হলো “লিডার কারা? অথবা, কে লিডার?”
একটি দেশি গল্প পড়ুন। একবার একটি কলেজ এইচএসসি’র রেজাল্টে সারাদেশে ১ম অবস্থানে চলে এল। পাশের হার ১০০ শতাংশ এবং সবাই এ প্লাস পেয়েছে। বিষয়ভিত্তিক বিবেচনায় সবচেয়ে ভাল হয়েছে কেমিস্ট্রি ও ইংরেজির ফলাফল। কলেজটিতে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের আনন্দের বন্যা বইছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শুরু হলো ছবি তোলা, আপলোডিং, নাচানাচি, হৈচৈ, বাদ্যবাদন, খানাপিনা ইত্যাদি।
রিপোর্টার প্রিন্সিপালের সাক্ষাৎকার নিতে গেল। কিন্তু প্রিন্সিপাল মহোদয় সাক্ষাৎকার দিতে চাচ্ছেন না। বলছেন- “আমার কেন? এমপি সাহেবের সাক্ষাৎকার নিন। তিনি এই কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতি।” তবুও রিপোর্টার প্রিন্সিপালের সাক্ষাৎকারই নিলেন। খবর প্রচারের সময় দেখা গেল ২৬ সেকেন্ডের বক্তব্যে প্রিন্সিপাল ২১ সেকেন্ডই অপার আনন্দে এমপি মহোদয়ের গুণকীর্তন করলেন।
পরের বছর অজ্ঞাত কারণে কলেজটির রেজাল্ট খুবই খারাপ হলো। পরীক্ষার্থীরা অনেক বিষয়েই ফেল করল। আশ্চর্যজনকভাবে সব থেকে বেশি ফেল করল ইংরেজি আর কেমিস্ট্রিতে!
প্রিন্সিপাল মহোদয় প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলেন! সেদিনই জরুরি সভা ডাকা হলো। পিনপতন নিরব ও রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রিন্সিপাল মহোদয় ভারী কন্ঠে টানা ৩ মিনিট ধরে শিক্ষকদের তিরস্কার করলেন, দোষারোপ করলেন এবং প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়লেন। শিক্ষকরা মাথা নিচু করে আতঙ্কিত হয়ে বসে রইলেন।
এবার সেই প্রিন্সিপাল একএক করে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইলেন – “তুমার বিষয়ে পুলাপাইন ফেল করল ক্যান? তুমি কি পড়াইলা?”
শিক্ষকদের উত্তরে প্রিন্সিপাল মহোদয় মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। কেমিস্ট্রি শিক্ষককে জঘন্য ভাষায় অপদস্ত করলেন, বিদ্রুপ করে হাসলেন।
এরপর তিনি ইংরেজি শিক্ষককে ঐ প্রশ্নটি করামাত্র ইংরেজি শিক্ষক বললেন-“স্যার, যারা ফেল করেছে, সবাই আপনার কারণে করেছে। এজন্য সবার আগে আপনি দায়ী।” সবাই অবাক। মাথা তুলে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। প্রিন্সিপাল কৃত্রিম রাগে কাঁপছেন। তথাপি নিজেকে সামলে নিয়ে তরল গলায় বললেন- “তুমি যা বললা তার ব্যাখ্যা দাও। না দিতে পারলে আমি এক্ষুণি মাননীয় এমপি মহোদয়কে টেলিফোন করে তোমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাব”। বলেই বুকপকেট থেকে নকিয়া ১১০০ মডেলের ফোন বের করলেন। ইংরেজি শিক্ষক বললেন- “স্যার, গতবছর আমরা ভাল রেজাল্ট করেছিলাম। টিভি চ্যানেলে কার সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছিল? ভাল রেজাল্টের জন্য সেদিন কাকে ক্রেডিট দেয়া হয়েছিল? আপনাকে।
ইংরেজিতে সব থেকে ভাল রেজাল্ট হলেও কেউ কি আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল? কীভাবে ভাল করলাম তা আমার কাছে কেউ জানতে চেয়েছিল? না।
আর এটাই স্বাভাবিক কেননা A Principal is all in all of a college. He is the first responsible leader for all teachers as well as the students. The fate of thousands of lives depends on his leadership. আপনার একটি “ইয়েস” অথবা একটি “নো” হাজারো ছাত্রছাত্রীর এমনকি তাদের পুরো পরিবারের ভাগ্যের চাকা চিরতরে ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু স্যার, আমাকে মাফ করবেন; আপনি সম্ভবত লিডারশীপ বলতে অন্যকিছু বোঝেন। আর এজন্যই গতবছর আপনি নিজের সাক্ষাৎকার দিতে চাননি। রিপোর্টারদের বলেছিলেন এমপি’র সাক্ষাৎকার নিতে। রিপোর্টাররা তবুও কিন্তু আপনার ইন্টারভিউই নিয়েছিল। Because they know you are the leader who can make the real change”.
পাঠকগণ, আপনারাই এবার ভেবে দেখুন- আসলে লিডার কারা, কেন আমাদের লিডারদের শিক্ষিত হওয়া উচিৎ। আর কীভাবে আমরা একটি চমৎকার লিডারশিপের অধীনে কাজ করতে পারি।
কল্পিত গল্পের প্রিন্সিপাল আসলে বাংলাদেশের অসংখ্য কলেজের প্রিন্সিপালের একটি রূপক। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এসব বিষয় খুবই কমন। এভাবেই চলতে হচ্ছে আমাদের।
গল্পের প্রকৃত লিডার কিন্তু এমপি নন। এখানে লিডারের কাজগুলো করার কথা প্রিন্সিপালের যদিও তিনি জানেনই না যে তিনি একজন লিডার। কারণ তিনি প্রকৃত শিক্ষা পাননি।
শিক্ষা কি, শিক্ষিত লিডাররা কীভাবে দায়িত্বশীল হয়ে একদল মানুষের জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেন, কীভাবে একটি এলাকার সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে দিতে পারেন -এসব অনুধাবনে প্রিন্সিপাল সারাজীবন ধরেই ব্যর্থ হয়েছেন। তাই, আমাদের লিডারদের সত্যিকারের শিক্ষা নিতে হবে। আর তা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একটি জনপদে, একটি সমাজে তারাই লিডার যাদের পরিকল্পনা, যাদের সিদ্ধান্ত, যাদের মুখের “হ্যাঁ” কিংবা “না” সেই সমাজের মানুষ বিশ্বাস করেন এবং এগুলো সেই জনপদের জন্য আলো কিংবা অন্ধকার হিসেবে কাজ করে। যার একটি ছোটখাটো ভুলের কারণে তার পুরো সমাজের মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই ভুগতে হয় কিংবা ভাগ্যের পরিনতি মেনে নিতে হয়; তাকেই আমরা লিডার ভাবব।
আমাদের সমাজ জীবনে মূল্যবান লিডার হলেন শিক্ষক, ডাক্তার, লেখক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, ইমাম, পুরোহিত, ধর্মীয় নেতা, আইনজীবী, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার, সরকারি কর্মকর্তা, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, ঠিকাদার- এঁরা। আমাদের জীবনদর্শন ও জীবনমানের সূচক পরিবর্তন আসলে এঁদের হাত ধরেই ঘটে থাকে। বারবার এবং সবসময়।
আমরা বাঁচতে শিখি বা বেঁচে থাকার মূল্যবোধ অর্জন করি তাঁদের অনুগ্রহে, উৎসাহে, সহায়তায় কিংবা তাঁদের উদাসীন অবহেলায়। ঝড়তুফানময় সমুদ্রে এঁরা আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন। এমনকি অন্ধকার রাত্রিতেও যাঁরা শুধু তারার আলো ধরে আমাদের জাহাজটিকে চালিয়ে নিয়ে যান অদম্য সাহসিকতায়, তাঁরাই আমাদের প্রকৃত লিডার।
আমরা তাঁদের ভালবাসি এবং বিশ্বাস করি। সুতরাং তাঁদেরকে সুশিক্ষিত হতে হবে; ঠিক এই মুহূর্ত থেকে। রাষ্ট্র তাঁদেরকে শেখাবে- হাউ টু লিড আর রাষ্ট্রকে জানতে হবে- হাউ টু এডুকেট দ্য লিডার্স।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক নতুন বাজার ৭১.কম
*লেখাটি `দৈনিক শিক্ষা` পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত
|