মাসুম হাসান
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের ধারণাটি বর্তমানে বেশ আলোচিত হচ্ছে, বিশেষ করে যখন দেশটি শিক্ষার মান উন্নত করার এবং সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। জাতীয়করণ শিক্ষার মানকে একীভূত করতে এবং বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে, যাতে প্রতিটি শিশুর একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়, তাদের পটভূমি নির্বিশেষে। তবে, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা, উল্লেখযোগ্য সম্পদ, এবং সমাজের সকল স্তরের সমর্থন প্রয়োজন।
**একটি স্পষ্ট নীতিমালা ও আইনগত কাঠামো তৈরি করা**
বাংলাদেশে শিক্ষা জাতীয়করণের প্রথম পদক্ষেপ হল একটি সুস্পষ্ট জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা। এই নীতিমালা স্পষ্টভাবে জাতীয়কৃত শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য এবং নীতিগুলি নির্ধারণ করতে হবে, যা সমান প্রবেশাধিকার, উচ্চমানের শিক্ষা এবং সকল শিক্ষার্থীর জন্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার উপর জোর দিতে হবে।
নীতিমালার পাশাপাশি আইনগত সংস্কারও প্রয়োজন। বিদ্যমান আইনগুলি সংশোধন বা নতুন আইন প্রবর্তন অন্তর্ভুক্ত করতে পারে যা একটি একীভূত পাঠ্যক্রমের সহায়তা করবে, শিক্ষার প্রশাসন কেন্দ্রীভূত করবে, এবং বেসরকারি ও ধর্মীয় স্কুলগুলোকে(মাদ্রাসা) নিয়ন্ত্রণ করবে। একটি বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন কার্যকর করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যাতে সকল শিশু একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত স্কুলে উপস্থিত থাকে।
### **একটি একীভূত পাঠ্যক্রম উন্নয়ন**
জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় অংশ হল একটি উন্নত জাতীয় পাঠ্যক্রম উন্নয়ন। এই পাঠ্যক্রমটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের এবং সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ চাহিদার সাথে মানানসই হতে হবে। এটি শুধুমাত্র একাডেমিক উৎকর্ষতা নয় বরং সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃজনশীলতা, এবং একটি শক্তিশালী জাতীয় পরিচয় তৈরি করার ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে - এমন হওয়া সমীচীন।
এছাড়াও, মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক তৈরি এবং বিতরণ করতে হবে যাতে সকল স্কুলে একটি অভিন্ন শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ করা যায়। একটি পরিষ্কার ভাষা নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যা বাংলা ভাষাকে শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে অগ্রাধিকার দেবে, পাশাপাশি ইংরেজি এবং আঞ্চলিক ভাষাগুলিও অন্তর্ভুক্ত করবে যাতে শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক পাঠ্যধারায় অধ্যয়নের সুযোগের জন্য প্রস্তুত হয়।
### **প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সহজীকরণ**
জাতীয়করণের জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত প্রশাসন প্রয়োজন। একটি জাতীয় শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত বা শক্তিশালী করা যেতে পারে যা পাঠ্যক্রমের বাস্তবায়ন, শিক্ষক নিয়োগ এবং স্কুল স্বীকৃতি পর্যবেক্ষণ করবে। এই বোর্ডটি নিশ্চিত করবে যে শিক্ষার মান দেশজুড়ে সমানভাবে বজায় থাকে।
যদিও কেন্দ্রীভূতকরণ গুরুত্বপূর্ণ, স্থানীয় স্তরে কিছু নমনীয়তা দেওয়াও জরুরি। স্থানীয় অফিসগুলি স্কুলগুলোকে স্থানীয় স্তরে পরিচালনা এবং পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করতে পারে, যাতে তারা বিশেষ চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে এবং তাদের সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ করতে সক্ষম হয়।
### **শিক্ষকদের উন্নয়নে বিনিয়োগ**
শিক্ষকরা যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি। তাই, শিক্ষক নিয়োগকে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং নিশ্চিত করা যে সব শিক্ষক জাতীয় যোগ্যতার মান পূরণ করেন, তা অপরিহার্য। নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি, প্রযুক্তি সংযোজন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার চর্চাগুলির উপর শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
যোগ্য শিক্ষকদের ধরে রাখতে, বিশেষ করে গ্রামীণ এবং স্বল্পোন্নত এলাকায়, সরকারের উচ্চতর বেতন, বাসস্থান এবং অন্যান্য সুবিধাসহ প্রণোদনা দেওয়া উচিত।
**স্কুল অবকাঠামো ও সম্পদ উন্নয়ন**
জাতীয়করণ সফল করতে হলে স্কুল অবকাঠামোর উপর উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। এতে শ্রেণীকক্ষ, লাইব্রেরি, পরীক্ষাগার এবং স্যানিটেশন সুবিধাগুলি নির্মাণ ও উন্নত করা অন্তর্ভুক্ত, বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায়।
শিক্ষার প্রযুক্তিগত অংশও সংহত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল শিক্ষার সরঞ্জাম, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং কম্পিউটার ল্যাব প্রদান করতে হবে যাতে সমস্ত শিক্ষার্থী আধুনিক শিক্ষার সম্পদ থেকে উপকৃত হতে পারে।
সম্পদ সুষমভাবে বিতরণের উপরও মনোযোগ দিতে হবে। পিছিয়ে পড়া এলাকায় স্কুলগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত যাতে বৈষম্য কমানো যায় এবং সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায়।
**মান ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা**
উচ্চ শিক্ষার মান বজায় রাখতে, নিয়মিত জাতীয় মূল্যায়ন করতে হবে যাতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স পর্যবেক্ষণ করা যায়। স্কুল পরিদর্শন এবং প্রতিক্রিয়া পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ যাতে কোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা যায়।
জাতীয়কৃত ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি মূলনীতি হওয়া উচিত। বিশেষ চাহিদার শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রোগ্রাম এবং সম্পদ উন্নয়ন করা উচিত যাতে তারা সমানভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে। লিঙ্গ সমতা প্রচার করা উচিত, যাতে মেয়েরা শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা না থাকে এবং পাঠ্যক্রম লিঙ্গ-সংবেদনশীল হয়।
**বেসরকারি ও ধর্মীয় স্কুলের(মাদ্রাসা) অন্তর্ভুক্তি**
জাতীয়করণের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল বেসরকারি এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরির মাদ্রাসাগুলির অন্তর্ভুক্তি। মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় পাঠ্যক্রমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ের সমন্বিত শিক্ষা পায়।
বেসরকারি স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে তারা জাতীয় মান পূরণ করে, তবে তাদের কিছু স্বাধীনতা বজায় রাখা উচিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে সহযোগিতা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একীকরণে সহায়ক হতে হবে যা সকল শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মেটাবে।
### **জনসাধারণের সচেতনতা ও সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ**
জাতীয়করণের সফলতা অর্জনের জন্য জনসাধারণের সচেতনতা এবং সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণকে জাতীয়করণের সুবিধা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে সচেতনতা প্রচারাভিযান চালানো উচিত। স্থানীয় সম্প্রদায়, পিতামাতা এবং অন্যান্য অংশীদারদের কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত যাতে শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বজনীন প্রয়োজন মেটাতে পারে।
### **অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও টেকসইতা**
জাতীয়করণ প্রক্রিয়া সফল করতে উল্লেখযোগ্য আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। সরকারের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা Prioritize করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়া সমর্থনের জন্য যথেষ্ট তহবিল বরাদ্দ করতে হবে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
জাতীয়কৃত ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং খরচ-কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
### **চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও এগিয়ে যাওয়া**
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ চ্যালেঞ্জিং হলেও, এটি একটি অর্জনযোগ্য লক্ষ্য। এর সফলতা নির্ভর করবে শক্তিশালী রাজনৈতিক ইচ্ছা, স্থিতিশীল শাসন এবং সমস্ত অংশীদারের সক্রিয় অংশগ্রহণের উপর।
নীতিমালা সংস্কার, পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মান পর্যবেক্ষণ সহ একটি ধাপে ধাপে পদ্ধতি গ্রহণ করে, বাংলাদেশ একটি সমান, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
জাতীয়করণ শুধুমাত্র শিক্ষার মান একীভূত করা নয়, এটি একটি শক্তিশালী, একক জাতি গড়ে তোলার ব্যাপার যেখানে প্রতিটি শিশুর সফল হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, নতুন বাজার ৭১.কম
*লেখাটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্ল্যাটফর্ম (চ্যাট জিপিটি ও জেমিনাই) ব্যবহার করে তৈরী করা হয়েছে।
|