মাসুম হাসান
বাংলাদেশের শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান, উপলব্ধি এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক ধরণের ভাবনা মনে মালা গেথেছে৷ তারই প্রতিফলন এই লেখাটি যেখানে বিস্তারিত তত্ত্ব কথার নির্যাস প্রবচন আকারে প্রকাশিত হলো৷
১. এদেশের ছাত্রদের ‘স্কুলপালানো’ একটা কমন ব্যাপার। অপরাধ বিবেচিত হলেও ‘স্কুলপালানো’ আসলে ট্যালেন্টেড ছাত্রদের এক ধরণের প্রতিবাদ; আমাদের আকর্ষণহীন ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
শিক্ষাপদ্ধতি ঠিক থাকলে এই ওয়াইল্ড ট্যালেন্টেড ছাত্রদের হয়ত আমরা ক্লাশরুমে ধরে রাখতে পারতাম৷
২. পৃথিবীর সর্বত্র ছাত্র-ছাত্রীরাই সম্ভবত সবচে’ বেশি প্রতিবাদ করে এবং প্রচলিত আচার-বিচার-সংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি ও সাহস রাখে কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদেরকে প্রায়শই বাস্তবতা বিবর্জিত পথে পরিচালিত করে৷
৩. সরকার নানা কায়দায় আসলে ছাত্রদের জোর করেই A+ ধরিয়ে দিচ্ছে। সম্ভবত এটা সুদীর্ঘ চক্রান্ত যাতে প্রতিভাবান, মেধাবী ও বুদ্ধিমান মানবসম্পদ এদেশে আর তৈরি না হয়!
কারণ, মেধাহীনরা খুব অনুগত, ভক্ত এবং মুরিদ টাইপ হয়; অথচ মেধাবীরা ঘটায় বিপ্লব যা ক্ষমতাসীনরা কখনওই চায় না।
আর তাই, শিক্ষাব্যবস্থাকে চিৎ-কাইত, ওলট-পালট, ওপর-নিচ করে, পালাক্রমে কিংবা উপর্যুপরি, নিয়মিত বলাৎকারেরই কাঙ্ক্ষিত ফসল এই A+পাওয়া অসহায় ছাত্রছাত্রীরা!
৪. এদেশে ছাত্রদের স্বপ্ন দেখানো হয় নির্মম মিথ্যা দিয়ে। “Aim in Life” বা “জীবনের লক্ষ্য” রচনা পড়তে গিয়ে ছাত্ররা নিজেদের স্বপ্নহীন যাত্রায় বুঝতে পারে বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে, পাস করেই নিজ গ্রামে চলে যাবে, সেখানে দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তুলবে এবং “ফ্রি ট্রিটমেন্ট” দিতে শুরু করবে৷
বিজ্ঞান বিভাগ ছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা কিংবা মানবিক বিভাগের ছাত্ররাও ডাক্তার হওয়ার মতো দুঃস্বপ্ন দেখে! আমাদের ছেলেমেয়েদের এসব অস্পৃশ্য স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্নভঙ্গের পথে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া, যা অন্যায়, বন্ধ করা খুব জরুরি।
প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষার্জন করে তরুণদের ১ম লক্ষ্য, হতে পারত “মহান কৃষক” হওয়ার স্বপ্ন৷ কিন্তু এমনটা ভাবা যেন আরেক দুঃস্বপ্ন৷
৫. জ্ঞান ও শিক্ষা কাউকে দেয়া যায় না যদি সে তা নিতে না জানে।
৬. বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ও প্রশাসন বুঝতে চাইলে রাজধানী পর্যন্ত যেতে হয় না। দেশের যেকোনো প্রান্তের একটি প্রাইমারি স্কুলে গেলেই আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। কারণ, প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন এখন এক একটা “মিনি পলিটিকাল গভর্নমেন্ট”! সরকার-প্রেতাত্না প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আছর করে আছে!
৭. এখন শিক্ষকরা ক্লাশরুমে পড়ান না; কিছুক্ষণ পর ঐ ছাত্রদের অন্যত্র পড়াবেন বলে তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলেন!
৮. বর্তমানে শিশুদের সঠিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হলো তাদের “আম্মুরা”। আম্মুরা স্কুলগুলোর চারপাশে সারাদিন বসে থাকেন প্রতিটি বাচ্চাকে “ফার্স্ট” বানানোর জন্য! তারা অবিবেচকের মতো প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্শা-হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি শেখাচ্ছেন অবুঝ শিশুদের।
৯. বর্তমান শিক্ষা, সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের যাপিত জীবন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক দেশটির কথা একবার ভাবুন দু’চোখ বুঁজে; একটি পুরোনো কথা মনে পড়বে আপনার—
“উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট”!
১০. প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কল্যাণে এদেশের তরুণতরুণীরা অনেক অগ্রসর হয়েছে; তবে আরো এগুতে পারত যদি তাদের বাবা-মা এবং কম-জানা ও একগুঁয়ে শিক্ষকরা তাদেরকে বাঁধা দিয়ে পিছিয়ে না দিত।
১১. অকারণে রেগে যাওয়া এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থ প্রশাসকদের শেষ মারণাস্ত্র!
১২. বর্তমানে উচ্চপদস্থ শিক্ষিত ব্যক্তিরা সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল। তাঁরা(তারা) নিজ নিজ চেয়ারে বসে যদি শুধু লিগ্যাল কথাগুলো বলতেন আর নিজ দায়িত্বগুলো অবহেলা না করতেন, তাহলে এদেশের সাধারণ মানুষের জীবন অনিবার্যভাবে বদলে যেত।
১৩. এদেশের নেতৃস্থানীয় (রাজনীতিক নেতা নয়) লোকজনকে, যারা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, হতে হবে অনেক বেশি সুশিক্ষিত ও নির্লোভ। তাদের একটি “হ্যা” অথবা “না” পুরো জাতির ভাগ্যে যে কত বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম তা তারা জানেন না।
১৪. এখন তথাকথিত শিক্ষিত প্রশাসকরা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে কপট থেকে কপটতর হচ্ছে। এদের চোখের ভেতর স্বপ্ন নেই কোনো; আছে বিদ্বেষ, অহমিকা, গোপন অসততা আর আত্ন-প্রেম।
১৫. এদেশে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি মানুষের মনোজগতকে অবরুদ্ধ করে রাখে৷ ফলে, কেউই সমাজে Alternative Reality বা বিকল্প বাস্তবতার অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না;
বরং যেকোনো নতুন বা সমান্তরাল অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটাই এখানকার সংস্কৃতি।
১৬. সম্ভবত, আমাদের শিক্ষাদর্শনই মানুষে মানুষে বৈষম্য ও দূরত্ব বাড়াতে সহায়তা করছে।
১৭. বাংলাদেশে আর্থনীতিক সমাজবাস্তবতা আর সাধারণ মানুষের উপার্জনগত বৈষম্য এতটা তীব্র যে, এখানে মানুষ শিক্ষিত হওয়ার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করে না।
১৮. শিক্ষিত নারীদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেক নারী দোকান থেকে নিজে সিগারেট কিনতে কিংবা জনসমক্ষে সিগারেট টানতে দ্বিধা করছে না।
এতে আমার কষ্ট লাগে কেননা তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে।
এতে আমার কষ্ট লাগে না; কেননা পুরুষের সাথে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীরা একধাপ এগিয়ে গেছে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক নতুন বাজার ৭১.কম
|