গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে আইনের শাসনের সরাসরি একটা সম্পর্ক আছে। আমরা যদি গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি তাহলে, গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের পঞ্চম অঙ্গ হিসেবে। ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটিতে রাষ্ট্র যখন তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, এ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে যদি কোথাও ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে সেই ব্যত্যয়গুলো গণমাধ্যম তুলে ধরে। তখন জনগণকে জানাতে গিয়ে তারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা রক্ষা করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম একটা অবদান রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, গণমাধ্যম তার এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কতটুকু স্বচ্ছতা রক্ষা করে? প্রশ্নটা আসে গণমাধ্যম যখন সরকারের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাচ্ছে, তখন গণমাধ্যম যদি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাহলে কার কাছে গিয়ে তাদের জবাবদিহিতা চাওয়া যায়?
এই যে স্বচ্ছতার আইডিয়া, এটা আসলে পুরনো একটা ধারণা। স্বচ্ছতা কিংবা জবাবদিহিতা কোথাও না কোথাও শেষ করতে হবে। প্রত্যেকে যদি একজন আরেকজনের ওপর লাগে, তাহলে এটাতে ইনফিনি ডি ডাউন সিচুয়েশন তৈরি হয়। জবাবদিহিতাও থাকা দরকার, সেটা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, জবাবদিহিতার নামে আপনি যদি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেন এটাও কাম্য হবে না। আমরা সাংবিধানিক ব্যাখ্যায় যেটা দেখেছি যে আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, প্রত্যেক নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন যে আইনগন রেস্ট্রিকশনগুলো আছে, মানবাধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ রেস্ট্রিকশনগুলো কি? আর্টিক্যাল ৩৯-এ বলা আছে, আপনি মানহানিকর কোনোকিছু লিখতে পারবেন না, কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হানিকর এবং আদালত অবমাননাকর কোনোকিছু করতে পারেন না। সো এর বাইরে অলমোস্ট আপনার সবকিছুর জন্য গণমাধ্যমকে একটা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আমরা বাস্তব ক্ষেত্রে যেটা দেখেছি সেটা হচ্ছে যে কিছু কিছু সংবাদপত্র মানুষের রাইট টু ইনফরমেশনের স্বীকৃতি বা বাক-স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং গণমাধ্যমের যে স্বীকৃতি সেটা এক করে দেখা হচ্ছে। এটারই অপব্যবহার করে অনেক পত্রিকা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোনো একজন রাজনীতিবিদ বা কোনো টার্গেটেড ব্যক্তিত্বে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের ইমেজ ক্ষুণ্ন করার একটা চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এসব সিচুয়েশনে গণমাধ্যমকে যাতে করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায় এ জন্যই একটা জবাবদিহিতার কথা বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশে যদি আইনের প্রয়োগের কথা বলা হয়ে থাকে তাহলে আমি বলব অন্যান্য ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগে গাফিলতি দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগও দেখা যায় লিগ্যাল সিস্টেমটাকে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন উদাহরণও অনেক রয়েছে। এগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটেই নয় যে কোনো সময়ের আইনের প্রয়োগের কথা বলে থাকেন তাহলে ওই বিষয়টা এখনো দুর্বলই রয়ে গেছে। এ দুর্বল রয়ে গেছে দেখেই সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে যে জবাবদিহিতা থাকা উচিত সেটাও অনুপস্থিত দেখা যায়। একইভাবে দেখা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা রক্ষা করার কথা বলতে গিয়ে সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধের ঘটনাও আমরা দেখেছি। তার মানে হচ্ছে সরকারের কর্তৃপক্ষ বা আইনশৃঙ্খালা বাহিনী, যাই বলেন না কেন, দুদিকেই তাদের এক ধরনের আইন মানা না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এমনটা চললে তাহলে আইনের শাসনের যে কথাটা বলা হচ্ছে তা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।
আইনের শাসন বলতে আসলে কী বুঝায়? আইনের শাসন পুরনো একটা ধারণা। একজন দার্শনিক এবি ডাইসি, তিনি আইনের শাসনের সংজ্ঞাটা দিয়েছিলেন এভাবে, ‘রাষ্ট্র পরিচালনা করার সময় যে আইনের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুধু আইনটাকে প্রধান্য দেওয়া হবে, ওই আইনটাকে প্রধান্য দিতে গিয়ে কোন ব্যক্তি কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সেটা মুখ্য নয়, আইনের চোখে যখন সবাইকে সমানভাবে দেখা হবে এবং আইনের প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে হবে তখনই বলা যাবে একটা দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান রয়েছে।
এ আইনের শাসন বিদ্যমান থাকার যে প্রচেষ্টা সেটার সঙ্গেই গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা আমি মনে করি গণমাধ্যমগুলো তাদের যে বাক-স্বাধীনতা তা পুরোপুরি ভোগ করছে এবং কোনো পত্রিকা বলেন, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বলেন, সরকারের সমালোচনা বলেন, সরকারের ভুলত্রুটি শুধরে দেওয়ার ক্ষেত্রে বা জনগণের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে না। সেটা এক ধরনের হেলদি অ্যাডমিনিস্ট্রেটি তৈরি করেছে যাতে করে মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারটা বাস্তবায়ন করতে পারছে। প্রকৃতপক্ষে আইনের শাসন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা কতটুকু? গণমাধ্যমের এখনো অনেক সুযোগ রয়ে গেছে যে, আইনের শাসন বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রয়েছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বা তাদের যদি কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে থাকে সেগুলোর জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে মানুষের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত করা যেতে পারে।
স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে রিসেন্টলি নতুন আইন তৈরির কথা যে বলা হচ্ছে ৫৭ ধারা গণমাধ্যমের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। এ আইনটাকে ব্যবহার করে গণমাধ্যমের অনেক কর্মীকে মামলা হয়রানি বিভিন্ন পত্রিকার কণ্ঠরোধের কথা বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ৫৭ ধারা সংবিধানের সঙ্গে কতটুকু সামাঞ্জস্যপূর্ণ সেটাও প্রশ্ন উঠেছে। একই ধরনের একটা ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট তাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সেটা বাতিল করেছে। ৫৭ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশে হাই কোর্টে যেসব মামলা করা হয়েছে সেগুলো এখনো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এখন সরকারের যে নিত্যনতুন আইন তৈরি হচ্ছে সেগুলো কতটুকু গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা বা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হবে না, এটা একটা আশঙ্কার মতো তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি একটা নতুন আইন প্রস্তাব করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এটাতেও বেশ কিছু ধারা সংবাদপত্রের কিংবা গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থ পরিপন্থী বলে গণমাধ্যমকর্মী এবং সুশীল সমাজের লোকজন আপত্তি জানিয়েছেন।
এটার মধ্যে বিশেষত ৩২ ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ৩২ ধারার এ আইনটি অন্যান্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও চেষ্টা করা হচ্ছে। ৩২ ধারায় যেটা বলা হয়েছে যে, কোন সরকারি অফিসে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে যদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে কোনো ধরনের কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয় কিংবা কোনো ধরনের গোপনীয় নথি এবং তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাহলে সেটাকে একটা গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবে ধরা হবে। এর জন্য ব্যাপক শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আমার মনে হয় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের যে বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত, সেটা এমন একটা আইন তৈরি করা হচ্ছে যেটা মানুষের বাক-স্বাধীনতার যে মৌলিক অধিকার আছে, সেটাকে কিছুটা হলেও সংকোচিত করবে। যখন মানুষের মৌলিক অধিকার সংকোচিত করার মতো না হয়ে মৌলিক অধিকার রক্ষাকবচের মতো আইন হতে হবে। বর্তমান যে আইনটা প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ বা যুগোপযোগী হয়নি। এ প্রস্তাবিত আইনে যেসব ফেইক ট্রাম ব্যবহার করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা জরুরি। বিশেষ করে ৩২ ধারাটি বাদ দেওয়া উচিত। যদিও সরকার বলছে ৩২ ধারা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। এ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। যে কেউ হয়রানিমূলকভাবে এটা ব্যবহার করবে। আইনের শাসনের কথা বলে অনেক ক্ষেত্রে হয়রানি করা হচ্ছে, এ আইনটি করার আগে বিশেষজ্ঞ, স্ট্রেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা আইন করা উচিত।