আওরঙ্গজেব কামাল :
দেশের ও জাতির প্রয়েজনে সাংবাদিকদের বাচিয়ে রাখতে হবে।
সাংবাদিক বা গণমাধ্যম পিছিয়ে গেলে দেশ ও জাতি পিছিয়ে পড়বে। তাই
সাংবাদিকদের উচিত সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দেশে স্বার্থে সাহসের
সাথে সত্য সংবাদ তুলে আনা । দেশের স্বার্থ ও সাংবাদিকতা এক ও অভিন্ন।
মানুষ সবসময় সঠিক তথ্য চায়। ভুয়া নিউজ সমাজকে শেষ করে দেয়। এখন ৫ম শিল্প
বিপ্লব চলছে, রোবোটিকস যুগ। তাই সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের ভাবা
দরকার। বর্তমানে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান শত্রুতা এবং নতুন
প্রযুক্তির উত্থানের সাথে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া হুমকিগুলি আরও জটিল
হয়ে উঠছে। এই হুমকিগুলি শারীরিক, আইনী, অনলাইন এবং অর্থনৈতিক মত
প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য অ্যাক্সেসের জন্য প্রভাব ফেলে৷ফলে
সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এখন অতি জরুরী
হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানীর মাত্রা বহুগুন বেড়ে
চলেছে। শুনতে যেমনই হইক না কেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের এরকম নির্যাতনের
শিকার হওয়ার ঘটনা কোন বিরল ঘটনা নয়, বরং এ প্রবণতা বাড়ছে । তার পরেও
নানা কারণে আইনের আশ্রয়ও নিতে চান না ক্ষতিগ্রস্থ অনেক সাংবাদিক। কারন
আইন খুব কম সময় সাংবাদিকদের পক্ষে থাকে। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে
সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের বেড়ে যাওয়ায় পেশাগত
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এ পেশার অনেকেই। আমার
জানা মতে সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় কোন প্ল্যাটফর্ম না থাকায়
এই পেশা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আইনের দীর্ঘসূত্রিতা, জটিল
বিচারিক প্রক্রিয়া সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান পক্ষ থেকে কোন ধরণের
সহযোগিতা না থাকার কারণে সাংবাদিক নির্যাতন ও সহিংসতা থামানো যাচ্ছেনা।
সাংবাদিক নির্যাতনের মামলাগুলো দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। একের পর
এক তারিখ পড়তে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইনগুলোয়
সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা সেভাবে বলা নেই। এ কারণে তারা দ্রুত বিচার পান
না। এছাড়া তাদের কোন সাপোর্ট সিস্টেম নেই যারা তাদের এসব সমস্যা নিয়ে
কথা বলবে। এসব কারণে অনেক সময় দেখা যায় সাংবাদিকরা নির্যাতন, হয়রানি
বা হুমকি-ধমকির শিকার হলেও বিষয়গুলো নিয়ে আইনি লড়াই করতে চান না
সাংবাদিকরা। এছাড়া অধিকাংশ সাংবাদিক অর্থ অভাব ও পেশী শক্তির ভয়ে আইনি
লড়াই থেকে বিরত থাকে। কেননা মামলা করতে গেলে প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাপোর্ট
লাগে বা অর্থনৈতিকভাবে যে সাপোর্ট লাগে, সেটা তাদের সবার থাকেনা। এ
অবস্থায় বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। অধিকাংশ সাংবাদিক সমস্যায়
পড়লে তার প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাপোর্ট সে সহযোগীতা সে পায়না। অনেক
ক্ষেত্রে ঐ প্রতিষ্ঠান তাকে অস্বীকার করে বা বহিস্কার করে। ফলে অধিকাংশ
সাংবাদিক নিজের সমস্যা যে ভাবে হউক নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করে । যে
কারনে অপাধীরা পার পেয়ে যায় এবং পুনরায় সাংবাদিকদের হয়রানী করে।
আন্তর্জাতিক ৬টি মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসে
বাংলাদেশে ৫৬ জন সাংবাদিক সরকার ও সরকার সমর্থকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত
হয়েছেন। তারা বলেছে, সাংবাদিক এবং স্বাধীনভাবে সরকারের নীতি ও
কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে তারা উদ্বিগ্ন।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড
অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, কমিটি টু প্রজেক্ট জার্নালিস্ট,
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস এবং
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার তারা বলেছে, সাংবাদিক এবং স্বাধীনভাবে সরকারের
নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে তারা
উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ব্যাপক
বিধিনিষেধ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে উন্মুক্ত
রাজনৈতিক বিতর্কের সম্ভাবনাকে দুর্বল করছে। সেন্টার ফর গভর্নেন্স
স্টাডিজের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়ন
হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের মে মাসের শুরুর দিক পর্যন্ত সাংবাদিকদের
বিরুদ্ধে অন্তত ৩৩৯টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।বিবৃতিতে বলা
হয়েছে, নিউজরুমগুলোকে আরও আত্মনিয়ন্ত্রণের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটগুলো থেকে প্রতিবেদন
সরিয়ে দেওয়া হবে। কেননা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ইন্টারনেট থেকে
প্রয়োজনীয় তথ্য বা ডেটা অপসারণ ও ব্লক করার অনুমতি রয়েছে সরকারের।
তাহলে কি ভাবে সাংবাদিকরা স্বাধীন ভাবে কাজ করবে এ প্রশ্ন সর্বসাধারনের ।
এছাড়া এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ১১৮ জন সাংবাদিক আহত ও
লাঞ্ছিত হয়েছেন। এছাড়া জুন মাসেই তিন গণমাধ্যমকর্মী খুন হয়েছেন। ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইন সংশোধনসহ সাংবাদিক খুন ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচার দাবি
করেছে আর্টিকেল নাইনটিন। বিশ্বজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের
সুরক্ষার অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন এক বিবৃতিতে
বলেছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের অধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাসহ নির্যাতনের ধারা
অব্যাহত। এই প্রবণতা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরিস্থিতির ক্রমাবনত নাজুক
অবস্থা ও বিচারহীনতার পরিস্থিতি নির্দেশ করে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা
আইনে দেশজুড়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও ভাবে মামলা ও নির্যাতন অব্যহত
রয়েছে। শুধু ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সারা দেশে সাংবাদিকদের
ওপর ৬২টি শারীরিক হামলা হয়েছে। এ সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৩
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১০টি মামলায় ৩ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২১
সালে ৭১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলায় ১৬ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার
হন। সচেতন নাগরিক, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর এসব ঘটনার প্রভাবে দেশে
একটি ভয়ের পরিবেশ ও সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে । সাংবাদিক হয়রানিতে ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এর বাইরে আরও
কমপক্ষে ২০ ধরনের আইনের মোকাবিলা করতে হয় সাংবাদিকদের। নির্যাতন, হয়রানি
আর আইনের নানা খড়গ নিয়ে বাংলাদেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন সাংবাদিকরা।
এর বিপরীতে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো আইন নেই, নেই কোনো
প্রতিষ্ঠান। এছাড়া নির্ধারিত আইনের বাইরেও সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য
চুরি, ডাকাতি, হত্যা ধর্ষণের মতো মিথ্যা মামলায়ও জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আর এই সব মামলা করার অভিযোগ
আছে। অবশ্যই এর কিছুটা কারন ও রযেছে যে টা হলো,তথ্যবিকৃতি বর্তমান
সাংবাদিকতার প্রধান সমস্যা। ডিজিটাল যুগে এর চর্চা আরও বেড়েছে। প্রথম
সারির সংবাদমাধ্যমও সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে
অপসাংবাদিকতায় লিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া
একজন সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার অভাব, নানা বিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে। এখন
প্রয়োজন প্রকৃত সাংবাদিকতা কে প্রতিষ্ঠিত করা। বর্তমানে দেখা প্রকৃত
সাংবাদিকরা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে।
বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি নিজ
পেশায় সন্তুষ্ট নন। পেশা ছেড়ে দিতে চান ৭১ শতাংশের বেশি সাংবাদিক। অন্য
দিকে নানা বিষয় নিয়ে বিষণ্নতায় ভুগছেন ৪২ শতাংশের বেশি সাংবাদিক।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সংবাদপত্র, স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ
পোর্টালগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এ ফল জানা
গেছে। যখন প্রকৃত সাংবাদিকরা অন্য পেশায় সেই যুযোগে নানা অপরাধী ও
অর্থশালী দূরর্নীতিবাজরা এই পেশায় ঢুকে পেশাটাকে প্রশ্ন বৃদ্ধ করছে। এখন
কেহ সাংবাদ লিখতে পারুক আর না পারুক সামান্য কিছু টাকা পত্রিকার বা
মিডিয়ার মালিকদের দেয়ে পরিচয় পত্র সংগ্রহ করে হয়ে যাচ্ছে সাংবাদিক। এখন
তারাই এই পেশাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। ফলে প্রকৃত সাংবাদিকতায়
ঝুকি বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বেশি এমন
দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বেশি। এর সহজ কারণটি হলো—মুক্ত
গণমাধ্যম স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে; যা দুর্নীতি
কমায় ও উদ্ভাবনী শক্তিকে ত্বরান্বিত করে, যা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের জন্য
সহায়ক।মুক্ত এবং স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য ও
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মাধ্যমে নাগরিকরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথ্য জানার
পাশাপাশি তাদের নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য
জানতে পারে। স্বাধীন গণমাধ্যমের অধিকারের বিষয়টি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার
দলিলের পাশাপাশি বাংলাদেশসহ অনেক দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পরিশেষে আমি বলবো এখন আর বসে থাকার সময় নেই, ঐক্যবন্ধ হয়ে এই পেশাকে
বাচিয়ে রাখতে হবে।
লেখক ও গবেষক : -
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব
|