ঠিক কিছুদিন আগেও বিশ্ব মিডিয়ার চোখ ছিলো চীনের দিকে। কী ঘটছে চীনে? প্রতিটি মুহূর্তের ঘটনার দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা বিশ্ব। ঘটনার বিষয়বস্তু এক হলেও দিক পরিবর্তন ঘটছে ঠিক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত। বিশ্বে প্রাদুর্ভাব বেড়ে গিয়েছে করোনাভাইরাসের। ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটিতে করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশিরা।
চীনে যখন এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকে কড়া সতর্ক ছিলো দক্ষিণ কোরিয়া।
তবে সব ধরনের সতর্কতা ডিঙ্গিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেছে করোনাভাইরাস। যখন দুই একজনের মাঝে এই সংক্রমণ দেখা দিয়েছিলো তখনো তেমন বড় ধরনের উদ্বেগ দেখা যায়নি। হঠাৎ গত সপ্তাহ থেকে জ্যামিতিক হারেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ভাইরাসটি। আর তখনই কোরিয়ার বুকে নিস্তব্ধতার ছায়া আর জনজীবনে আতঙ্ক নেমে আসে।
কোরিয়ানরাসহ সবার চোখে মুখে চরম উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের কালো ছাপ। দক্ষিণ কোরিয়াতে রবিবার পর্যন্ত কোরোনা ভাইরাসে মারা গিয়েছে ৭ জন। আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িছে ৭৬৩ জনে। এই বাস্তবতাকে জরুরি পরিস্থিতি বলে বর্ণনা করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং সাই-কিয়ুন। দফায় দফায় মেডিকেল বোর্ডে সঙ্গে বসছেন দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিকে রাষ্ট্রপতি মুন জায়ে-ইন দক্ষিণ কোরিয়র সরকারকে প্রয়েজনীয় সকল ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া নির্দেশ দিয়েছেন। জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা।
চীনে যেমন উহান শহরকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে দেখা হচ্ছে, ঠিক তেমনি কোরিয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলীয় পাশাপাশি দুটো শহরকে- দেগু এবং চোংডোয় এই ভাইরাস ছড়ানোর সূত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই দুই শহরকে ‘স্পেশাল কেয়ার জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে এখন আর শুধু দেগু আর চোংডোতে সিমাবদ্ধ নেই পুরো কোরিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। রাজধানী সিউলে সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬২ জনে, দেগু ১৪৪ জন, থোংইয়ং ৪৭ জন, গিমচন ৩২ জন, গোয়াংজু ৩১ জন, দেজনে ২৫ জন, ইনচন ৩৯জন। এছাড়াও অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এই করোনাভাইরাস। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ভাইরাসের বিস্তার রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কোরিয়ার সরকার। অসুস্থদের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম, শয্যা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছে সরকার।
স্থবির হয়ে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের জনজীবন। অধিক প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে কেউই বের হচ্ছে না। গত দুইদিন ধরে রাস্তায় মানুষজন নেই বললেই চলে। জনমানবশূন্য কোরিয়ার বাজারগুলো।
তিন সেনার শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ায় সব সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং এর একটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্যামসাং মোবাইল ডিভাইস ফ্যাক্টরিতে একব্যাক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে পুরো কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় চাকরি ও পড়াশোনার জন্য প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশির বসবাস। এই পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝেও বড় ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। কোরিয়স্থ সকল বাংলাদেশিদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করার জন্য বলেছেন দক্ষিণ কোরিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম। তিনি প্রবাসীদের সবসময় মাস্ক ব্যবহার করার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন।
দেগু শহরে বাস করা বাংলাদেশি জিয়াউর রহমান বিবিসিকে বলেছেন, রাস্তাঘাটে কেউ নেই, একদমই ফাঁকা। শিশুরা নেই, বয়স্ক লোকদেরও কাউকেই রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে না। গত দুই দিন ধরে এমন অবস্থা দেখছি।
তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় এই শহরে আছেন আট বছর ধরে, কাজ করেন একটি কারখানায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের একটা বড় অংশই এই দেগু শহরের। জিয়াউর রহমান বলেন, দেগুতে চার হাজারের বেশি বাংলাদেশি রয়েছে, এবং তাদের মধ্যে ফেসবুক বা অন্য উপায়ে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তাতে যেসব কথাবার্তা শুনছি - তাতে বুঝতে পারছি যে বাংলাদেশিরা ভীষণভাবে আতংকিত। আজকে একটা শপিং মলে গিয়েছিলাম বাজার করতে। খাদ্যদ্রব্য তেমন একটা নেই। ফলমূলের অভাব দেখা যাচ্ছে। মানুষজন আগেই সব কিনে ফেলেছে। বেচাকেনা মোটামুটি শেষ। হ্যান্ডওয়াশ কিনতে গিয়েছিলাম, পাইনি।
এমন অবস্থায় কিছুদিনের জন্য হলেও দেশে চলে যাবার চিন্তা করছেন কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে জিয়াউর রহমান বলেন, `না আমি এরকম চিন্তা করি নাই। আমি এখানেই নিরাপদ থাকার চেষ্টা করবো। আমি আমার কাজের জায়গা থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকি। এই পথটা আমি সাইকেল চালিয়ে আসি। এই যাতায়াতটা আমার কাছে এক বিরাট আতংকের বিষয়। এই রাস্তাটুকুতে আমার কারো সাথে দেখা হলে কি হবে না হবে - এটা আমার এক বিরাট আতংক।`
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন বলছেন, এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আগামি কয়েকদিন কী ঘটে তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।