নিজামউদ্দিন আহমেদঃ
কথায় আছে ‘বেড়ায় যদি ক্ষেত খায় তাহলে ক্ষেত ঠেকাবে কে?’ মানুষ জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে ছোটেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তাররা তার মেধা, শিক্ষা ও জ্ঞান দিয়ে রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। এজন্য তাদের বলা হয় মানবতার সেবক।
কিন্তু হাল আমলে এসে কি সেই চিত্র ডাক্তারেদের মাঝে দেখা যাচ্ছে? তারা মানবতা কথাটা উল্টে রেখে কিছু ডাক্তার এমন কুর্কীতি করে চলেছেন তাতে আর কিছু দিন পর মানুষ ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পাবে। তার চেয়ে রোগব্যাধিতে ধুঁকে মরাকে শ্রেয় মনে করবে মানুষ।
সম্প্রতি ডাক্তার সমাজে এমনই কলঙ্ক লেপে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের রেজিস্টার আমিনুল ইসলাম। তিনি জেনারেল সার্জন ও প্লাস্টিক সার্জন এবং বার্ন বিশেষজ্ঞ। ৩০০ শয্যা হাসপাতালের পাশে একাধিক প্রাইভেট ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালস্টেশন সেন্টারেও রোগী দেখেন।
ক্যান্সারে আক্রান্ত এক রোগীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে সেটা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি প্রদান করে বারবার ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে নানা কুকর্মের জন্য শিরোনাম হওয়া এই কুখ্যাত ডাক্তারের বিরুদ্ধে।
অভিযোগকারী নারী বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বা। তিনি ফতুল্লার বাসিন্দা। ওই নারীর মামলার প্রেক্ষিতে আদালত পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই) কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
ডাক্তার আমিনুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এই নারীই প্রথম এনেছেন এমন নয়। এরআগেও বহুবার তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় একই রকম অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু পার পেয়ে যাওয়ায় এই আমিনুল এখন হয়ে উঠেছে নারী রোগীদের জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালেও ১৪ জুন বন্দরের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেই ঘটনা তিনি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ধর্ষিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে সকলের মুখ বন্ধ করে দেন।
কিন্তু আমিনুলের যৌন লালসা দিন দিন চরম আকার ধারণ করে। ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর আবারো একজন সহযোগীকে নিয়ে হারপিক সেবন করা রোগী সহ আরো দুজন মেয়েকে তার যৌন লালসা মেটানোর জন্য এক কক্ষে নিয়ে যান।
সর্বশেষ গত বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক মোহাম্মদ শাহীন উদ্দীনের আদালতে ফতুল্লার অন্তসত্ত্বা নারী বাদী হয়ে ডাক্তার আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে।
চলতি মাসে আমিনুলের বিরুদ্ধে যে ধর্ষণ মামলা হয়েছে সেই মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁর বাদী থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত।
২০১৭ সালের ৩১ জুলাই তিনি থাইরোয়েড রোগের চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমিনুল ইসলামের খানপুরের নিজস্ব চেম্বার (গ্যাস্ট্রোলিভ ডায়াগোনস্টিক এন্ড কনসালস্টেশন সেন্টার) এ শরণাপন্ন হন।
পরবর্তীতে ওই বছরের ২০ আগস্ট বাদী আবারো আমিনুল ইসলামের চেম্বারে গেলে বাদীকে কিছু টেস্ট করতে হবে বলে বেডে শুতে বলেন। বাদী আসামীর সরল কথায় শুয়ে পড়েন। ইমার্জেন্সি ইনজেকশন নিতে হবে বলে ডাক্তার আমিনুল ইসলাম বাদীকে ইনজেকশন দিয়ে তার শরীর অবশ করে দেন।
ইনজেকশন দেয়ার পর বাদী শরীরের কোন অংশই নড়াচড়া করতে পারেনি। বাদীকে একা পেয়ে আমিনুল ধর্ষণ করেন। বাদী বুজতে পারলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। ধর্ষণের ৩ ঘন্টা পর বাদী ঘুমিয়ে পড়েন এবং ঘুম থেকে জেগে চিৎকার করলে তাকে জানায় ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করেছে ও বাড়াবাড়ি করলে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি প্রদান করে।
প্রতি সপ্তাহে আমিনুলের কাছে আসতে হবে এই ভয় দেখিয়ে তাকে চেম্বার থেকে বের করে দেয়। বাদী বিবাহিত নারী এবং আত্মসম্মানের ভয়ে স্বামীর কাছে ঘটনাটি লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এই ঘটনার পর আমিনুল ইসলাম বাদীকে মোবাইল ফোনে ভয় দেখাতে থাকে।
পরবর্তীতে নারীর স্বামীর কাছে পিয়ন দিয়ে খবর পাঠায় রোগীকে কিছু টেষ্ট করাতে হবে। বাদী যাওয়ায় অসম্মতি প্রকাশ করলেও তার স্বামী তার বোন ও তার মাকে সাথে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে বলেন। বাদীর বোনকে সাথে নিয়ে ওই ডাক্তারের চেম্বারে গেলে বাদীর বোন বের করে দিয়ে চেম্বারের দরজা লাগিয়ে দেন এবং জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করেন।
বাদী সে সময় চিৎকার দিলে সেখানে উপস্থিত কিছু মানুষ তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে তার বাসায় নিয়ে আসে। এই ঘটনার ২-৩দিন পর বাদীর স্বামী এসকল ঘটনা সম্পর্কে জেনে বাদীকে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
অপরদিকে ওই সময়ে নারী বুঝতে পারেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। সন্তানসম্ভবা ও শারীরিক ভাবে অসুস্থ হওয়ায় তার মামলা করতে দেরী করেছেন।
এদিকে জানা গেছে, আমিনুলের এই কুকর্মের কথা এতোদিন নীরবে সহ্য করে আসছিলেন তার স্ত্রী (সেবিকা) শিপন। আমিনুলের বিরুদ্ধে সদ্য যে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে সেই মামলার অন্যতম সাক্ষিও তিনি।
অনেকে ভাবেন হিস্র ও ভয়ংকর আমিনুলের থাবার ভেতর পরতে পারেন তার স্ত্রীও। সূত্র জানিয়েছে, শিকার ধরতে আমিনুলের পাঠানো ভিডিওই কাল হয়ে উঠেছে তার জন্য। এবার তার নিস্তার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধর্ষণের অভিযোগ কিংবা ঘটনা জানাজানির পরপরই আপোষ মিমাংসার প্রস্তাব দিয়ে দফারফা করার চেষ্টা চালায় কুখ্যাত ডাক্তার আমিনুল। ফতুল্লার ওই নারী মামলা করার আগে তাকে নিয়েও এমন আপোষনামা সাজিয়ে ধর্ষণের ঘটনা চাপা দিতে চেয়েছিলো আমিনুল।
‘আইন সয়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন নারায়ণগঞ্জে প্রথম ওই নারীকে ডেকে আপোষনামার মাধ্যমে মিমাংসার চেষ্টা চলে। ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার ঘটনাটিকে উভয়পক্ষের মধ্যে ক্রুটি বিচ্যুতি আর ভুল বুঝাবুঝি হিসেবে উল্লেখ করা হয় আপোষ নামায়।
আর ধর্ষণের ঘটনাটি সামান্য আলাপ আলোচনায় সমাধান হবে বলে মত দেয়া হয়। ওই অফিসের কর্মকর্তা হাইউল ইসলাম হাবিবের মধ্যস্থতায় আপোষনামায় কয়েকজন স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে অঙ্গীকার করানো হয়, ধর্ষণের অভিযোগ করা কিংবা ধর্ষক কেউই কারো বিরুদ্ধে কোন আদালত, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম তথা অন্য কোথাও কোন অভিযোগ করবেনা, মানহানির চেষ্টাও করবেনা।
কিন্তু নারীলিপ্সু আমিনুল এরপরেও থেমে থাকেনি। ওই আপোষ নামায় ইমতিয়াজ আহমেদ, মো.নুরুল ইসলাম, হাবিব প্রধানসহ অন্য এক নারীর স্বাক্ষর করানো হয়।
দুধর্ষ এই ডাক্তারের ব্যাপাওে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু জাহেরের কাছে মুঠোফোনে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডা. আমিনুল ইসলামের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে তাকেই প্রশ্ন করেন। তার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। ৩০০ শয্যা হাসপাতালের এই ডাক্তারের উপর ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি রাগান্বিত হয়ে মুঠোফোন কেটে দেন।
তবে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ডা. দেবাশীষ সাহা ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ডা.আমিনুলের বিষয়ে বলেন, আমরা এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। পিবিআই এই বিষয়ে তদন্ত করছে। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি।
পিবিআইয়ের তদন্তে এই বিষয় প্রমাণিত হয়ে গেলে এবং আমাদের তদন্তেও একই বিষয় উঠে আসলে বিএমএ’র পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হবে এবং সেই সাথে বিএমডিসির কাছে (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) তার চিকিৎসকের সনদ বাতিলের জন্য আবেদন করব। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রমাণিত হলে তার উপর সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ফতুল্লার ওই নারীর অভিযোগ অনুসারে গেষ্টোলিভ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যোগাযোগ করা হলে কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘এই ধরণের কোন ঘটনা এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঘটেনি। একজন ডাক্তারের জন্য একজন করে এ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে। এছাড়া চেম্বারের বাইরে অনেক রোগীও থাকে। এই ধরণের ঘটনা ঘটলে ওই সময় অন্্য রোগীরা ডাক্তারকে ছেড়ে দিত না।’
বারবার ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ডাক্তার আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘একজন ডাক্তারের কাছে সব রোগীই বয়স অনুসারে কেউ মা, কেউ মেয়ে, কেউ বাবা, কেউ সন্তানের মতো। গত ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে ওই রোগীনি আদালতে আমার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
এ ধরণের কোন ঘটনা চেম্বারে ঘটার কোন সুযোগ নেই। ওই রোগীনি আমার কাছে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছে। কেন সে এমন অভিযোগ করলো সেই বলতে পারবে। আদালত থেকে তদন্ত দেওয়া হয়েছে সত্যটা বেরিয়ে আসবে।’
|