স্টাফ করেসপন্ডেন্ট:
১৫ আগস্ট। তখনো ভোর হয়নি, অন্ধকার রয়ে গেছে। ঢাকা সেনানিবাসে আমাদের এলাকার অনেকগুলো বাড়ি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের (বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দলের সদস্য) অনুগত সেনারা ঘেরাও করে ফেলে। রশিদ সম্ভবত আমার বাসাতেই আগে আসে। আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলল, সে এবং ফারুক ব্যাটালিয়ন ট্রুপসকে ক্যু করার জন্য হুকুম দিয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই মুহূর্তে ট্রুপসের সঙ্গে তোমার কোনো যোগাযোগ আছে কি?’ সে বলল, ‘কোনো যোগাযোগ নেই।’ আমি তাকে বললাম, ‘এর পরিণতি কী হবে বুঝতে পারছ?’ রশিদ আমাকে উল্টো বলল, ‘আমি যে হুকুমটা দিয়েছি, সেটা এই মুহূর্তে ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু আমাকে যদি সেনাবাহিনী গুলি করতে চায়, তাহলে এই স্টেন দিলাম। যে কেউ আমাকে গুলি করতে পারবে।’ প্রয়াত মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ শীর্ষক বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। সদ্য প্রকাশিত ওই বইয়ে আরও লেখা হয়েছে, সে (রশিদ) নানা ইমোশনাল কথা বলছিল। ওই সব কথাবার্তা বাদ দিয়ে আমি তাকে বললাম, ‘গো অ্যান্ড টক টু চিফ অব আর্মি স্টাফ অ্যান্ড দেন সেটেল দ্য ইস্যু। তোমার সারেন্ডার করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’ আরও বললাম, ‘তোমার এই অ্যাকশন সেনাবাহিনীকে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’ আমি বুঝলাম, সে আমাকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চায়। চিন্তা করলাম, আমি রশিদের অনুগত সেনাদের হাতে ঘেরাও হয়ে আছি। তার অনুগত সেনাদের কাছে মেশিনগানসহ অন্যান্য অস্ত্র রয়েছে। এ অবস্থায় কৌশলী হতে হবে। রশিদ আমাকে তার সঙ্গে মেজর হাফিজের বাসায় যেতে বলল। আমি বেসামরিক পোশাক পরে তার সঙ্গে প্রথমে হাফিজের বাসায় গেলাম। মেজর হাফিজ এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে রশিদ কর্নেল শাফায়াত জামিলের বাসায় গেল। তার বাসাও রশিদের অনুগত সেনারা ঘেরাও করে রেখেছিল। রশিদ আগে কর্নেল শাফায়াত জামিলের বাসায় যায়। মেজর হাফিজ আর আমি পরে ঢুকি। যখন ভেতরে ঢুকছি, তখন দেখলাম, রশিদ বলছে, উই হ্যাভ ক্যাপচারড স্টেট পাওয়ার আন্ডার খন্দকার মোশতাক। শেখ ইজ কিলড, ডু নট ট্রাই টু টেক অ্যানি অ্যাকশনস অ্যাগেইনস্ট আস। তখন শাফায়াত জামিল কিছুটা হকচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অবশ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার এ অবস্থা কেটে যায়। এরপর তিনি খুব রাগান্বিত স্বরে রশিদকে বললেন, ‘হুই ইজ হি টু টেক দিজ টাইপ অব রাবিশ অ্যাকশন অ্যান্ড স্টুপিড অ্যাক্টিভিটি।’ তিনি খুব জোরে জোরে ধমক ও শাসানি দিয়ে বললেন, ‘আই উইল কোর্ট মার্শাল টু ইউ।’ এরপর রশিদ তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এই সময় সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ শাফায়াত জামিলের বাসায় ফোন করেন। তাদের দুজনের কথোপকথন আমার সামনে হয়নি। কারণ, টেলিফোন ছিল বেডরুমে। পরে জেনেছি, সেনাপ্রধান তাকে জিজ্ঞেস করেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা আক্রমণ করেছে, তা তিনি জানেন কি না। জবাবে শাফায়াত জামিল বলেন, তিনি জানেন না। তবে রশিদ তাকে এ কথা বলেছে। এরপর সফিউল্লাহ শাফায়াত জামিলকে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে (সফিউল্লাহ) টেলিফোনে জানিয়েছেন যে আক্রমণকারীরা সম্ভবত শেখ কামালকে মেরে ফেলেছে। সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলে শাফায়াত জামিল তার অধীন তিন কমান্ডিং অফিসারকে ফোন করে ব্যাটালিয়নকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি ড্রয়িংরুমে আসেন। তখন আমি শাফায়াত জামিলকে বললাম, ‘স্যার, এই মুহূর্তে আপনার উচিত হবে প্রথমে ট্রুপসের কাছে যাওয়া। রশিদ বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। তার অনুগত সেনাদের হাতে লোডেড আর্মস রয়েছে। বেশি রাগারাগি করতে গিয়ে সে যদি এখনই গোলাগুলি শুরু করে দেয়? আমরা তো সবাই নিরস্ত্র এখানে। তাই এই মুহূর্তে রাগারাগি করাটা ঠিক হবে না। বরং আমাদের কায়দা করে আগে ট্রুপসের কাছে যেতে হবে। কিন্তু রশিদ সে কাজ করার সুযোগ আমাদের দেবে না। সে আমাদের চোখে চোখে রাখছে।’ এরপর আমরা ওখান থেকে বের হয়ে হেঁটে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে যাই। আমাদের পেছনে পেছনে রশিদও আসে। খুব কাছেই ছিল জিয়ার বাড়ি। তিনি তখন উপ-সেনাপ্রধান। যখন আমরা তার বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন পথে রেডিওতে শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। পথে কোথাও একটি রেডিও অন করা ছিল। শুনে আমার খারাপ লাগল। আমরা তিনজন একসঙ্গে জিয়ার বাড়িতে গেলাম। আমাদের দেখে গার্ড গেট খুলে দিল। আমরা ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। শাফায়াত জামিল কোনায় গিয়ে দাঁড়ালেন। জিয়া সিল্পিং পোশাকে প্রায় দৌড়ে এলেন। তিনি তখন শেভ করছিলেন। এক গালে শেভ করছেন, অন্য গালে সাবান। এসেই বললেন, ‘শাফায়াত, হোয়াট হ্যাজ হ্যাপেন্ড?’ শাফায়াত জামিল বললেন, ‘অ্যাপেরেন্টলি টু ব্যাটালিয়ন হ্যাজ স্টেজ আ ক্যু।’ জিয়া বললেন, ‘শাফায়াত, উই আর নট ডেকোর, গেট ব্যাক দ্য ট্যাংকস’, অর্থাৎ আমরা তো বসে থাকার জন্য এখানে আসি নাই, ট্যাংকগুলো এখনই ফেরত নিয়ে আসো।’ এ কথা বলার পরপরই শাফায়াত বললেন, ‘এইমাত্র রেডিওতে ঘোষণা করা হচ্ছে, দে হ্যাভ কিলড দ্য প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান’, অর্থাৎ ‘তারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে।’ ‘সো হোয়াট, লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার’, অর্থাৎ ‘তাতে কী হয়েছে, উপরাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে দিন।’ এই কথাগুলো যখন হচ্ছিল, তখন কিন্তু রশিদ আরেকটা দরজার সামনে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা জিয়ার বাড়ি থেকে বের হলাম। তখন আবার রেডিওর ঘোষণা শুনতে পেলাম। রশিদ আমাদের ছেড়ে চলে গেল। শাফায়াত জামিল তার ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে গেলেন। আমি বাসায় এসে তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে সেনাসদরে গেলাম। সেখান থেকে গেলাম চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টারে। সেখানে তখন মিনি কনফারেন্স হচ্ছিল। খালেদ মোশাররফ সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন। দুটি বিষয় আলোচিত হলো। এক. এই মুহূর্তে যদি তাদের নিরস্ত্র করা যায়, তাহলে ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াবে না। আর যদি এই মুহূর্তে নিরস্ত্র করতে না পারা যায়, তাহলে যেসব সেনা বিদ্রোহ করেছে, তাদের বাদ দিয়ে বাকি সবাইকে সেনানিবাসের ভেতরে আনতে হবে। চেইন অব কমান্ড ঠিকমতো জারি করে সুযোগ বুঝে একটা কাউন্টার অ্যাকটিভিটিজ চালিয়ে তাদের নিরস্ত্র করতে হবে। এ ধরনের কথাবার্তা যখন চলছিল, তখন আরআরকে সজ্জিত জিপে করে একটা স্টেনগান হাতে মেজর শরীফুল হক ডালিম সেনাসদরে ঢোকে। ডালিম চাকরিচ্যুত হয়েও সেদিন ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। ডালিম যখন সেনাসদরে ঢোকে, তখন সেনাসদরে যত সেনা কর্মকর্তা ছিল, তাদের সবাই সরে যায়। ডালিম সরাসরি চিফ অব স্টাফের অফিসে ঢুকে যায়। সেখানে দুই-তিনজন অফিসারসহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আর আমি ছিলাম। খালেদ মোশাররফ আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেনাপ্রধানের রুমের ভেতরে ঢোকে। বাকি সেনা কর্মকর্তারা বাইরে থাকলেন। খালেদ মোশাররফ আমাকে সেনাপ্রধান ও ডালিমের মাঝখানে দাঁড়াতে বললেন। ডালিম অত্যন্ত রাগান্বিত স্বরে কথাবার্তা বলছিল এবং স্টেনগান নাড়াচ্ছিল। এতে যেকোনো মুহূর্তে স্টেনগানের গুলি বেরিয়ে যেতে পারত। সেনাপ্রধানকে বললেন, খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য সে সেনাপ্রধানকে চাপ দিতে থাকে (হয়তো মোশতাকই ডালিমকে সেনাপ্রধানের কাছে পাঠিয়েছিল তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য)। এরপর সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেডে রওনা দেন। তার পেছনে ডালিমও রওনা হয়। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আমিও সেখানে গেলাম। একটু পর সেখান থেকে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ডালিমের সঙ্গে রেডিও স্টেশনের দিকে যান। তখন রেডিও স্টেশন ছিল শাহবাগে (হোটেল রূপসী বাংলা ও বারডেম হাসপাতালের মাঝের ভবন)। সেনাপ্রধান রেডিও স্টেশনের দিকে রওনা দেওয়ার পর চতুর্থ বেঙ্গলের সবাই আবার আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আলোচনার বিষয়বস্তু, এরকম একটা অভ্যুত্থান কি করে সম্ভব হলো, এখন আমাদের করণীয় কি ইত্যাদি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ঘণ্টা খানেক পর ফিরে এলেন। এই সময় সেনা কর্মকর্তারা রক্ষীবাহিনী নিয়ে বেশ উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছিলেন। সেনারাও রক্ষীবাহিনী নিয়ে নানা ধরনের জল্পনাকল্পনা করছিল। কেউ কেউ বলছিল, রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারে, যুদ্ধ করতে পারে ইত্যাদি। একপর্যায়ে দুই-তিনজন বললেন, বিমানবাহিনী দিয়ে রক্ষীবাহিনীর ওপর আঘাত বা আক্রমণ করা হোক। আমি এর বিরোধিতা করি। আমি বললাম, এই কাজটা করা কোনোক্রমেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। তরুণ যুবক নিয়ে গঠিত রক্ষীবাহিনী। একটা বড় ধরনের হত্যাকান্ডের ব্যাপার নিয়ে সেনাবাহিনী হাবুডুবু খাচ্ছে। এরপর যদি এই ধরনের কাজ করা হয়, তবে তা খুবই মারাত্মক হবে। আরেকটা ঘটনা না ঘটিয়ে আমরা যদি রক্ষীবাহিনীকে আশ্বস্ত করে বলি যে যা হয়েছে তা সেনাবাহিনীর কাজ নয়। যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা অবসরপ্রাপ্ত লোক। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অল্প কিছু সদস্য এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেনাবাহিনী কোনোক্রমেই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। আর বঙ্গবন্ধু যেহেতু মারা গেছেন, রক্ষীবাহিনী আর কার জন্য যুদ্ধ করতে যাবে? বরং সেনাবাহিনীতে তাদের আত্তীকরণ করলে ভালো হবে। বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে তাদের ভেতরে যে অস্থিরতা চলছে, সেটা কমে যাবে। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ এ পরামর্শ গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে ১৬ বেঙ্গলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তারা সাভারে গিয়ে যেন রক্ষীবাহিনীকে নিরস্ত্র করে।
|