বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে (দুই কন্যা ছাড়া) নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। হত্যা করা হলো আপন বড় ভগ্নিপতি কৃষক নেতা বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, স্নেহের ছোট ভাই শেখ আবু নাসের ও আপন বড় বোনের বড় পুত্র যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী কে। অর্থাৎ ওই দিন ভোররাত্রে মোট 16 জন মানুষকে নির্মম নিশংস ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। যখন এই হত্যাযজ্ঞ চলে সে সময় আমার বয়স পাঁচ বছর হবে, কারণ ১৯৭০ এর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ভাগে আমার জন্ম। স্বাধীনতার সময় মাত্র এক-দেড় বছরের একজন শিশু ছিলাম। মায়ের মুখে শুনেছি, অনেকের মুখে স্লোগান শুনে শুনে নিজেও ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলতাম "জয় বাংগা বাংগার জয়" তখনো `ল`উচ্চারণ করতে পারতাম না। পারিবারিক আবহে এবং পরবর্তীতে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে মুজিব আদর্শের একজন মানুষ হিসেবে বারবার শুধু মাথায় ঘুরপাক খেত এবং এখনো খায়, কি অপরাধ ছিল জাতির পিতার, তার পরিবারের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনের? কেন তাকে এই নির্মমভাবে হত্যা করা হলো? কি অপরাধ ছিল তার পরিবারের অপরাপর সদস্যদের? তিনি কি জানতেন না তার জীবনের উপরে আঘাত আসতে পারে? তিনি কি জেনেও সেটাকে আমলে নেননি? তিনি কি কখনো কল্পনা করেছিলেন তার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেওয়া মানুষগুলোই একত্রিত হয়ে এভাবে তার উপর নির্মমতা দেখাবে? এরকম হাজারো প্রশ্ন সেই ছোটবেলা থেকেই মাথায় ঘুরপাক খায়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় অনেক জায়গায় অনেক বক্তৃতা করতে হয়, অনেক কথাই বলি কিন্তু কোথায় যেন এখনো মিলাতে পারিনা। আমরা যদি ঘাতক মোশতাকের কথাই ধরি, ওই ঘাতক বিভিন্ন কূটকৌশলে স্বাধীনতার পর হতেই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছে চলে গিয়েছিল, তা না হলে তিনি তো শেখ কামালের বিবাহের উকিল বাবা হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুতে আপনজন হিসেবেই কবরে নেমে তাকে দাফন করেছিল এবং তার মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি কান্নাকাটি করেছিল যেটা শোনা যায়। বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিনের রাতের প্রথম প্রহরে হাঁসের মাংস রান্না করে তিনি তাকে খাইয়ে গিয়েছিলেন। এই সবকিছুই তাঁর ঘনিষ্ঠ তার চিত্র ফুটিয়ে তোলে।এরকম আরো অনেক ঘটনাই খুনি মোস্তাক এর ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল। একইভাবে জিয়াউর রহমান যিনি যুদ্ধকালীন সময়ে একজন মেজর ছিলেন, যার স্ত্রীকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকায় বঙ্গবন্ধু তাকে তার নিজ কন্যাসম আখ্যা দিয়ে জিয়াকে অনুরোধ ও বাধ্য করেছিল স্ত্রীকে ঘরে তুলতে। জিয়াকে মেজর থেকে প্রমোশন দিয়ে সশস্ত্রবাহিনীর উপপ্রধান করেছিলেন, জেনারেল শফিউল্লাহ ছিলেন সেনাপ্রধান। জিয়াউর রহমান ছড়া সশস্ত্রবাহিনীর উপপ্রধান আর কেউ কখনোই হয়নি এবং আগামীতেও হবে না। এই পদটি শুধু তাকে পদায়ন করার জন্যই তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি করেছিলেন।এরকম সামরিক-বেসামরিক অনেককেই সুবিধা দিয়ে দেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন সর্বোচ্চ স্থানে পদায়ন করেছিলেন সেই সময়ের স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার। যেমন: হোসেন তৌফিক ইমাম ওরফে এইচটি ইমাম সাহেবকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক থেকে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কেবিনেট সেক্রেটারি করেছিলেন, এরকম আরো অনেক বেসামরিক কর্মকর্তাকেও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, সেই খন্দকার মোশতাক, সেই জিয়াউর রহমান কিভাবে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীন রাষ্ট্রপতি কে একটি রাষ্ট্রের জাতির পিতা কে হত্যা করে এবং সেই হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই অধ্যাদেশ জারি করে? বন্দুকের নলের মাথায় নিজেরা রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান হয়েছিলেন এবং ভয়-ভীতি দেখিয়ে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি কে দিয়ে তাদের শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। এগুলো ভাবলে ভীষণ কষ্ট লাগে ভাবতে অবাক লাগে। এই সমস্ত চাটুকাররা কিভাবে এত বড় কৃতঘ্ন হতে পারে? বিধিবাম তারা কেউ কিন্তু সুফল ভোগ করতে পারেনি। খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, এদেরকে জিয়া ক্ষমতাচ্যুত করে জেলে অন্তরীণ রেখেছিল। জিয়াউর রহমান ও ঘাতকদের সাথে তাদের সম্পর্ক পরবর্তীতে কখনোই ভালো যায়নি। শুরু হয়েছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, যার প্রেক্ষিতে মোস্তাকের ঘনিষ্ঠ সকলকেই জিয়াউর রহমান জেলে পুরে ছিল। উশৃংখল সেনা কর্মকর্তারা, যারা এই জঘন্য ঘটনার সাথে জড়িত ছিল তারা কেউই শান্তিতে থাকতে পারে নি। তারা এবং তাদের পরিবারের মানুষগুলো আর কখনোই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেনি। দেশের বুকে খুনিদের বিচার হয়েছে উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা, তাদের মুখে এবং বঙ্গবন্ধুর উপরে লেখা অনেক বই-পুস্তক থেকে জাতির পিতার মৃত্যু কালীন বিভীষিকাময় অনেক ঘটনাই জেনেছি। গত দুই দিনে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির সুযোগ্য সন্তান, যুবলীগ চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ ও ছোট পুত্র ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মান্যবর মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের স্মৃতিচারণমূলক লিখনি থেকে সেদিনের সেই বিভীষিকাময় লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের অনেক ঘটনাই জানলাম। আমার শুধু ভাবতে অবাক হয় কিভাবে দুটি শিশুর সম্মুখে তাদের পিতা-মাতাকে এতটা নির্মমতার সাথে নিজ দেশে, নিজ দেশের মানুষ হয়ে, তাদের বাড়িতে ঢুকে এভাবে হত্যা করতে পারে। যখন হত্যা করেছে তখন ঐ ঘাতকদের বুকটা কী একটু কেঁপে ওঠে নি? তখন ঐ ঘাতকদের হাত কি একটুও কাঁপেনি? কিভাবে এটা সম্ভব ছিল কি নিষ্ঠুরতা কি নির্মমতা। আমি শুধু আর একটি কথা বারবার ভাবি বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং ওই পরিবারের যারা সেদিন এই ঘটনার পরেও বেঁচে গিয়েছিলেন তারা ক্ষমতায় বসে কিভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে দেশ এবং রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যেতে পারেন? তারা কিভাবে এত বড় জঘন্য ঘটনার বিচার কোন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে না করে প্রচলিত নিয়মে রাষ্ট্রের সকল বিধি-বিধান মেনে একজন সাধারন মানুষকে হত্যার ন্যায় এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞ এর বিচার তারা করতে পারেন? যারা সেদিন অধ্যাদেশকে, আইনে পরিণত করেছিল, সেই সংসদে যারা তখন প্রতিনিধিত্ব করছিল, তখন তাদের বিবেক একটি বারের জন্যও কি কেঁদে ওঠে নি? একটি স্বাধীন দেশ, যেখানে একটু পশুকে হত্যা করলে তার বিচার হয় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ দেশের স্থপতি স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, তার পরিবার আত্মীয়-স্বজন কে হত্যা করে খুনিরা পার পেয়ে যাবে তাদের কোন বিচার হবে না, এই কালাকানুন কিভাবে তারা সেদিন পাস করেছিল? আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করি আমরাইতো কথাগুলোকে ভেবে বিচলিত হয়ে পড়ি। কখনো কখনো মনে হয় এত আইন মানার কি দরকার? তারা কোন আইন মেনে সেদিন জাতির জনকের বুকে গুলি চালিয়েছিল? সেখানে তার কন্যা, তার বেঁচে থাকা প্রিয় স্বজনরা এত বড় বেদনা নিয়ে কিভাবে এতকিছু কে ক্ষমা করে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে? এটা ভাবতেই কষ্ট লাগে। নতুন করে কাটার উপর লবণের ছিটা, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়া জাতির পিতার শাহাদাত দিবসে বিশ্ববেহায়া বিশালাকৃতির কেক কেটে জন্মদিন পালন শুরু করলেন। তারা এটা কিভাবে পারে, শুনেছি খালেদা জিয়া স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আশ্রিতা দের মত যেতেন। সে কি বঙ্গমাতার হাতের খাবার খাননি? শিশু রাসেল কে ছোটাছুটি করতে দেখেননি? শেখ কামাল, শেখ জামাল তাদের স্ত্রীদের মুখগুলি একবারও কি তার মানস পটে ভেসে ওঠে নি? তাহলে সেই পিতাসম বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিনে, কিভাবে তার মিথ্যা জন্মদিন পালন করে? কোথায় গেল তার সেই আত্মঅহমিকা? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে আমার এই বিক্ষিপ্ত ভাবনা থেকে লিখা, অনেক কিছুই ভাবনা ছিল, অনেক কিছুই হয়তো গুছিয়ে লিখতে পারলাম না। তবুও জাতির জনক কে হারানোর এই দিনে বিক্ষিপ্ত ভাবনা থেকে কিছু লিখে মনটাকে হালকা করার চেষ্টা করলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির যোগ্য উত্তরাধিকার, আওয়ামী লীগ প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন। যারা জাতির পিতা কে হত্যা করে সবচেয়ে বেশি বেনিফিটেড হয়েছে, যারা এই হত্যার কুশীলব, যারা এই হত্যার সুবিধাভোগী, সেই সমস্ত খুনির দোসরদের চেহারাকে জাতির সামনে উন্মোচন করা উচিত। বিনয়ের সাথে বলতে চাই, সেদিনের সেই চরম ত্যাগ থেকে শিক্ষা নিয়ে, সকল চাটুকার, সকল মোসাহেব এবং দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সকল সুবিধাভোগী কে অচিরেই চিহ্নিত করে, মুজিব আদর্শের প্রকৃত সৈনিকদের সামনে এগিয়ে দিয়ে। কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যন্ত জাতির জনকের রেখে যাওয়া আদর্শের সংগঠন কে শক্তিশালী করে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও খুনি মোস্তাক জিয়ার আদর্শ লালিত সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে, বাংলার মাটিতে তাঁদের অপকর্মকে চিরজীবনের মতো কবর রচনা করতে হবে। যেন আর কোন দুর্বলতা সুযোগ নিয়ে কোন খুনি কোন মোসাহেব কোন অপশক্তি বিষাক্ত ফণা তুলতে না পারে। শোক কে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার স্বপ্নের বাংলা বাস্তবায়নে। এই হোক আজকের এই জাতীয় শোক দিবসের প্রতিশ্রুতি।। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। লেখক: সাবেক সভাপতি-বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, কুষ্টিয়া। ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা।।