আওরঙ্গজেব কামান
আজকের লেখাটির জন্য প্রথমে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। দয়া করে কেউ আমাকে
ভুল বুঝবেন না। বর্তমান পরিস্থিতির পরে আজকের বিশেষ প্রতিবেদন সাত পর্বের
প্রথম পর্ব। লিখতে কষ্ট হচ্ছে! তারপর ও লিখতে হচ্ছে, হয়তো আজকের লেখা
পেশাজীবী সাংবাদিকদের কিছুট উপকারে আসতে পারে। কিন্তু সত্যি ই বলতে এ
পরিবেশে সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখা অনেক কষ্ঠকর। গোটা সমাজ যখন আপনার
বিপক্ষে তখন আপনি কতটুকু বা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারবেন। হাজারো পেশার
মধ্যে সাংবাদিকতা একটি মহৎ ও সম্মানজনক পেশা। সব দিক থেকে সব পেশার চেয়ে
এ সাংবাদিকতা পেশা সবসময় এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতির
পেছনে সাংবাদিকতার অবদান সবচেয়ে বেশী। অন্য সব পেশার তুলনায় সাংবাদিকতা
পেশা মর্যাদাশীল।সব দিক থেকেও এ পেশা রয়েছে আর দশটি পেশার চেয়ে
উর্ধ্বে। তবে এর সঙ্গে আর অন্য দশটি পেশার পার্থক্য বহুগুন । গলায় কার্ড
ঝুলালে বা পত্রিকা কিংবা মিডিয়ায় কাজ করলে সাংবাদিক হওয়া যায় না। এখন
নিজের সাংবাদিকতা প্রমান করতে অনেকে পত্রিকা হাতে করে নিজের নামের
সংবাদটি দেখিয়ে বেড়ান। হয়তো খোজ নিয়ে দেখাযায় তিনি নিজে সাংবাদিকতা কি
সেটাও জানেন না। নিজের নামের সংবাদ কখনো তাকে সাংবাদিক প্রমান করে না।
একজন সাংবাদিক খুব নৈতিক হওয়ার পরও পেশাদারিত্ব বজায় না রাখলে অথবা
পেশাদারিত্ব থাকার পরও নৈতিক না হলে সাংবাদিকতা হয় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
সাংবাদিকদের দক্ষ হতে হয়। সাংবাদিককে সবসময় নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিয়ে এগিয়ে
যেতে হয়, যা প্রতিনিয়তই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত হতে হয়। আস্থা গড়ে
উঠতে বছরের পর বছর সময় লাগে, তবে এ আস্থা নষ্ট হতে কোনো একটি সংবাদই
যথেষ্ট। সাংবাদিকদের ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ভিন্নমত প্রকাশের সাহস
রাখতে হবে। এর মাধ্যমেই একটি সমাজের স্থায়িত্ব বেড়ে যায়। একজন ভালো ও
পেশাদার সাংবাদিক হতে হলে অবশ্যই তাকে হতে হবে সব বিষয়ে জ্ঞানী।
সাংবাদিকদের ‘সব কাজের কাজী’ হতে হয়। অর্থাৎ অনেক বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকা
একজন সাংবাদিকের জন্য অতি জরুরি। সাংবাদিক হতে হলে ১. সিদ্ধান্ত ২. সততা
৩. ব্যক্তিত্ব ৪. ব্যবহার ৫. সাহসিকতা ৬. বস্তুনিষ্ঠতা ৭. অধ্যবসায়
৮.নিয়মানুবর্তিতা ও যোগাযোগ ৯. দায়বদ্ধতা ১০. বিচক্ষণতার গুন থাকতে
হবে। অনেক সাংবাদিক এ সব বিষয়ে কিছুই জানেন না।শুধু নিজেদের রক্ষা করতে এ
পেশায় এসেছে। বর্তমানে লক্ষ করা যায় তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা
সাংবাদিকতা পেশায় ঝুঁকে পড়ছেন। অনেক অপরাধীরাও এ পেশায় ঢুক পড়ছে যেমন
সত্য তেমন অনেকেই সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের মান ক্ষুন্ন করে চলেছেন,
এদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি নিয়ম নিতীমালা
এবং পেশাদার সাংবাদিকদের ঐক্য। অনেক এক বা একাধিক সাংবাদিক সংগঠনে যুক্ত
থেকে নিজেকে সাংবাদিক হিসাবে প্রমান করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে একথা স্বীকার করতেই হবে, সাংবাদিক পেশায় আজও সিংহভাগ
সাংবাদিক অনাড়ি। তারা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ও প্রশিক্ষণহীন । সাংবাদিকতায়
পেশা কে দখল করে রেখেছে এক শ্রেনীর মুখোশ ধারীরা। বড় বড় সাংবাদিক সংগঠন
থেকে সকল ক্ষেত্রে তাদের অধিপত্য রয়েছে। অনেক সাংবাদিক রয়েছে পড়ালেখা
করাতো দূরে থাক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা একেবারে
কম। অথচ একটি সম্ভাবনাময় ও চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা আজ
দেশে-বিদেশে মাথা উঁচু মাপের পেশা। পৃথিবীতে যতগুলো পেশা আছে সাংবাদিকতা
তার মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। সাংবাদিকতা হল বিভিন্ন ঘটনাবলী,
বিষয়, ধারণা, মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কিত
প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন, যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে
প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দটি দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও
সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে বোঝায়। নাগরিক সাংবাদিকতা প্রকারান্তরে
নাগরিক মত ও মুক্তমত প্রকাশের একটি ধরনও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়
সরকার ও নাগরিকের মধ্যে । নাগরিক সাংবাদিকতা পরিচিতি পায় অনলাইন যুগের
নাগরিক কণ্ঠস্বরে বিকল্প গণমাধ্যম হিসাবে।নাগরিক সাংবাদিকতা প্রকারান্তরে
নাগরিক মত ও মুক্তমত প্রকাশের একটি ধরনও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়
সরকার ও নাগরিকের মধ্যে ভাব বিনিময়ে বা প্রতিক্রিয়া বিনিময়ে নাগরিক
সাংবাদিকতা কার্যকরি। এমনকি মূলধারার গণমাধ্যম যখন নাগরিক বিশ্বস্ততা
হারায় তখন নাগরিক সাংবাদিকতাই নাগরিকের চাহিদা মেটায়। পেশাদার
সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠত্ব যতই থাকুক, আদি সাংবাদিকতা মূলত নাগরিক
সাংবাদিকতাই। এখন আর এটা নেই। এখন ব্যাক্তি প্রয়োজনে সাংবাদিকতা চলছে।
এখন মানুষের ধারণা সাংবাদিকরা মূলত অহংকারী, অসংবেদনশীল এবং
পক্ষপাতদুষ্ট। মানুষের ক্ষতি করা ছাড়া তাদের কাজ নেই। সরকারী প্রশাসন, ও
সুশীল সমাজ সাংবাদিকদের শত্রু ভাবছে। খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা আস্তে আস্তে
হারিয়ে যাচ্ছে। খবরের প্রতি অনেকের ভূল ধারনা তৈরী হচ্ছে। সংবাদের প্রতি
মানুষের আস্তা করে যাচ্ছে। সংবাদে ভারসাম্য বজায় থাকছে না। আর এসব তৈরী
হয়েছে কতিপয় নামধারী সাংবাদিকের কারনে। সাংবাদিকের আচরণ হতে হবে ভদ্র,
সুরুচিসম্পন্ন এবং ন্যায্য। কার সাথে কতটুকু ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে, কতটুকু
দূরত্ব রাখতে হবে তা নিজেকেই বিচার করে চলতে হবে। কিন্ত এসব বিষয় নেই
বললে চলে। এতো কিছুর পরও কিছু মহৎ ব্যাক্তি মহান ব্রত নিয়ে সাংবাদিকতা
করে যাচ্ছেন। সমসাজের প্রতি দেশের প্রতি নিরড় দায়িত্ব পালন করে
যাচ্ছেন। হয়তো তাদের কারনে সাংবাদিকতার মান কিছুটা বেচে রয়েছে। মানুষ
যেখানে ভাবনা শেষ করে, সেখান থেকে একজন সাংবাদিক ভাবতে শুরু করেন। আর
আমরা এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নোংরা মানসিকতার
পরিচয় দিচ্ছি।এমন অনেক ঘটনায় একজন সাংবাদিককে যখন দেখি, রঙ্গ-তামাশায়
মেতে ওঠেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না পরিণতির দৌড়গোড়ায় মনে হয় আমরা।
দলীয়করণ, বিভক্তি এসব কারণে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো তো রসাতলে গেছেই।
প্রতিটি সংগঠন কয়েক খন্ডে বিভাক্ত হয়েছে। পত্যেকে এখন নেতা সেজেছে। এক
সংগঠনৈর নেতা অনন্য সংগঠনের নেতাকে মানতে চায়না।এক সাংবাদিক অপর
সাংবাদিকে মানতে চায়না। এমকি সাংবাদিক হিসাবে শিকার করতে চায়না। এছাড়া
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দাপটে নাস্তানাবুদ পুরো গণমাধ্যম। এখন
ফেসবুক রিপোর্টারের সংখ্যা বহুগুন বেড়েছে। অনেক ঘটনা নিয়ে হয় ট্রল। চলে
সেগুলো নিয়ে নগ্ন তামাশা। ক্ষণিকের আনন্দ আর লাইক-শেয়ার পেতে কাউকে
হেনস্তা করতে ছাড় দেয় না ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। তবে এতে একটা বিষয়
পরিষ্কার হয়, আপনি আসলে কেমন রুচি কিংবা মানসিকতার ধারক-বাহক। ফেসবুকের
আইডিতে যখন একজন সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় তুলে ধরছেন, তখন মনে রাখতে হবে-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি কী লিখবেন। কোন ঘটনাটিকে মানুষের সামনে
তুলে ধরবেন। কারণ সেটি দিয়েই ভার্চুয়াল বন্ধুরা পরিমাপ করবে আপনার
পরিবার-বন্ধুজন, রুচিবোধ। এসব কারনে বা নানা প্রতিকূলতা ও টানাপড়েনের
মাঝে বাংলাদেশে কর্মরত পেশাজীবী সাংবাদিকদের ৭১ শতাংশের বেশি পেশা ছেড়ে
দিতে চান। এবং বিষণ্নতায় ভুগছেন ৪২ শতাংশের বেশি সাংবাদিক। ইউনিভার্সিটি
অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া
স্টাডিজ এ গবেষণা থেকে এ তথ্য জানাযায়। আমার বিশ্বাস বর্তমান পরিস্থিতিতে
এই পেশার কর্মরতারা খুব সমস্যার মধ্যে রয়েছে। একশ্রেণীর লোক সাংবাদিক না
হয়েও সাংবাদিকতা ফলাচ্ছে পক্ষান্তরে পেশাজীবী সাংবাদিকরা অন্যত্রে
যাওয়ার চেষ্টা করছে এমন পরিস্থিতিতে জাতির বিবেক কোথায় দাঁড়াবে? মানুষ
বলতে শুরু করেছে ২০০ টাকা ও নাকি সাংবাদিক পাওয়া যায় এর মতন লজ্জাজনক
আর কি হতে পারে। জাতির বিবেক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভর এমন পরিস্থিতি দেশ
এবং জাতির জন্য হুমকি স্বরূপ। হয়তো রাতারাতি এসব পরিবর্তন করা কিংবা
শুধিয়ে নেওয়া যাবে না তবুও আমাদের সকলের চেষ্টা করতে হবে যেন প্রাণ
প্রিয় পেশাটি আবার তার সম্মান ফিরে পাক। তবে এ পেশার অনেকে এখনো সমাজের
অগ্রগতি ও পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে। কেউ বলুক বা না বলুক বর্তমান
বাংলাদেশের অগ্রগতির পেছনে সাংবাদিকতার একটি বড় অবদান রয়েছে, এটাই সত্য।
তবে এবার সময় হয়েছে সাংবাদিকতার যোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার। না
হলে হলুদ আর অপসাংবাদিকতায় হারিয়ে যাবে মুলধারার সাংবাদিকতা। রাস্ট্রের
চতুর্থ স্তম্ভ সাংবাদিকতার স্বর্ণযুগ ফিরে আনতে হলে এই সমস্ত খোঁড়া
যুক্তি ওয়ালা লোকদের হাত থেকে সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে সাংবাদিকতার
মানোন্নয়ন ও পেশাদার তৈরীর বিকল্প নেই।তা না হলে অপ সাংবাদিকদের ভিড়ে আসল
সাংবাদিকদের হারিয়ে যেতে হারিয়ে যেতে আর বেশিদিন সময় লাগবেনা।
লেখক ও গবেষক
|