আওরঙ্গজেব কামাল :
মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে প্রিয় রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান অতি নিকটে। এটি মুসলমানদের জন্য বিশেষ ইবাদত-বন্দেগির মাস। সারা বছরে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন হয় এ পবিত্র মাসে। পবিত্র রমজান মাসে বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ কুরআনুল কারিম প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিল হয়েছে। পবিত্র মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজ। যেখানে রমজান মাস উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মানুষের হাতের নাগালে রাখা হয়, সেখানে বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে রমজানকে কেন্দ্র করে পুরো রমজান মাস জুড়ে এবং রমজান শুরুর পূর্বেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যের ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে । রমজান শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের দাম নীরবে বাড়ানো হচ্ছে।এক মাসের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে সব ধরনের ডাল, ভোজ্যতেল, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, হলুদ-মরিচ, চিনি-লবণ এমনকি খেজুরের দাম বাড়ানো হয়েছে। গরুর মাংস ও মুরগির দামও বেড়েছে। বাড়তি দরে পণ্য কিনতে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। ভোক্তারা জানান, বরাবরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পরিকল্পিতভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত তিনদিন যাবত মাছের দাম বেড়েছে চরম ভাবে। ভূক্তভোগী তরিকুল ইসলাম জানাই,গত মাসে যেই পেঁয়াজ কিনছি ৮০/ ৯০ টাকা করে, আজকে সেইটা কিনে আনলাম ১২০ টাকা করে। চাল, ডাল, তেল, চিনি- সব জিনিসের দাম কেবল বেড়েই যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে চলবো। বিশেষ করে- ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছর রমজানে দাম বেশ বেড়ে যায়। সরকার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে, গত আটই ফেব্রুয়ারি চাল, চিনি, তেল ও খেজুরের আমদানি কর কমিয়েও দেয়া হয়। কিন্তু এরপর ভোক্তারা এর কোনো সুফল পাননি। উল্টো বাড়তে দেখা গেছে চিনি ও খেজুরের দাম। খোঁজ নিয়ে জানায়ায়, সরকার চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এছাড়া রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। একইভাবে, ভোজ্য তেল ও চিনি আমদানিতেও কর কমিয়ে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।রমজান উপলক্ষ্যে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম তেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া অপরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি মেট্রিক টনে আমদানি শুল্ক দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। আর পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক তিন হাজার টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা। গত একমাসের ব্যবধানে গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগির মাংস, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, হলুদ, দারুচিনি, তেজপাতা ইত্যাদি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় খোলা বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের সর্বোচ্চে দাম ছিল ৭০০ টাকা। কিন্ত আজ সেটি বিক্রি হতে দেখা গেছে ৭৫০ টাকা দরে। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৮৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০/২১৫ টাকায়। অন্যদিকে, গত এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম গড়ে প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। এদিকে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী বাজারে মনিটারিং ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে অথচ কোন ফল পাচ্ছে না ভূক্তভোগীরা। এবিষয়ে রাস্তায় পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই চাঁদাবাজি একটি বড় কারণ। এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সৈয়দ মো. বখতিয়ারও সড়কে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, “রাস্তায় পুলিশ চাঁদাবাজি করে, শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হয়, বাজারে চাঁদাবাজি হয়, সব জায়গায় চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব না। বাজার ঘুরে দেখা গেছে,সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমিয়েছে সরকার। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তেলের দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর এখনো বাজারে দেখা মিলছে না নতুন দামের সয়াবিন তেল। মার্চের শুরু থেকেই সয়াবিন তেলের দাম কমানোর কথা থাকলেও এখনো বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামেই। ফলে সয়াবিন তেলের দাম কমানো হলেও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। অথচ দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৮০ টাকা প্রতি কেজি খুচরা বাজারে। এদিকে প্রতি বছর রমজান মাস এলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হলেও তার প্রভাব বাজারে পড়ে না। ফলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়ে। এ বছরও রোজার মাস সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। অন্যদিকে রমজান মাসে বাজারে পণ্য সরবরাহ যেন স্বাভাবিক থাকে, সেজন্য বাকিতে আট পণ্য আমদানি করা যাবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে এখনই বাড়তে শুরু করেছে চাল, আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, ব্রয়লার, চিনি, চিড়াসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডলার সংকট ও ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বাজারে এসব সংকট ও জটিলতার প্রভাব এড়াতে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ধারে আট পণ্য আমদানির সুযোগ রেখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ। পণ্যগুলো হলো ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর।বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে রোজার সময় নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। কারণ বাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক চড়া। কোনো পণ্যের দাম কমছে না। এমনকি দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমার কোনো সুখবরও নেই বেশ দীর্ঘ সময়। যদিও বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের বাড়তি দামসহ নানা কারণে সে সুফল মিলছে না। সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সুলভে পণ্য বিক্রি করলেও ভোক্তার দুর্ভোগ কমেনি। রমাদানের পবিত্রতা রক্ষা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নগ্নতা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। আমি সকলের পক্ষ থেকে সরকারকে এসব গর্হিত কাজ বন্ধ করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করে মানুষের জানমাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকার্শন করছি। তাই আসুন, আমরা আগামী পবিত্র রমজান মাসকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও সহমর্মিতার সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই। রমজান মাসজুড়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে ভেজালমুক্ত হালাল খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন ও নৈতিক উন্নত চরিত্র গঠনে এগিয়ে আসি।
লেখক ও গবেষক
|