আওরঙ্গজেবকামাল
রাজনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা
গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন
হয়। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে, এমনকি জনগনের কাছেও জাতীয়
নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগন দেশ পরিচালনার
প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ পায় রাষ্ট্র
পরিচালনার ম্যান্ডেট, আবার কেউ পরাজিত হয়ে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য
জনসমর্থন আদায় করার চেষ্টা করে। কিন্ত বর্তমানে সে পরিস্থিতি নেই বলে
মনে করে অধিকাংশ রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের । এছাড়া রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে
শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কত টুকু সম্ভাব এ প্রশ্ন এখন সর্ব
সাধারনের মধ্যে বিরাজ মান। কারন বিগত দিনের নির্বাচন গুলি সংঘাত মুক্ত
হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটের দিন সহিংসতায় অন্তত ১৮ জন নিহত হয়।
১৪৭টি আসনে বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার কারণে প্রায় ১৪০টি কেন্দ্রে
ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। সে সময় ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা
জানিয়েছিলেন , ভোটকেন্দ্রে আগুন, ব্যালট পেপার পুড়িয়ে দেয়া কিংবা
ছিনিয়ে নেয়ার কারণে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সালের
ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর দিন
থেকে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত ২১ দিনে সারা দেশে ২২ জন নিহত ও ২১৭৯ জন
আহত হয়েছে৷ ভোটের দিনের সহিংসতা আগের ২০ দিনকে ছাড়িয়ে গেছে৷ ২৪ ঘণ্টায়
নিহত ১৭ ও আহত ৪৭ জন৷এছাড়া সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক,
উপনির্বাচন হোক—কোনো নির্বাচনই আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্রহণযোগ্য হতে
দেখিনি। কিন্তু অনিয়ম, কারচুপি বন্ধে নির্বাচন কমিশনের বলিষ্ঠ ভূমিকা
আমরা দেখতে পাইনি। নির্বাচন কমিশন হয়তো যুক্তি দিতে পারে, আইনের
অপ্রতুলতার কারণে তারা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী,
নির্বাচন কমিশনের হাতে যে অন্তনির্হিত ক্ষমতা দেওয়া আছে, তারও প্রয়োগ
করতে দেখিনি। তাহলে এবার নির্বাচনে কি হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে
দেশে ও দেশের বাইরে এবার যতটা আলোচনা–সমালোচনা প্রত্যক্ষ করছি,
উপমহাদেশের কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে এর আগে এমনটা ঘটেছে বলে আমার মনে হয়
না। বিশেষ করে বিশ্বের বড় বড় শক্তির মধ্যে টানাপোড়েন আমরা দেখছি। পর্দার
আড়াল থেকে নয়, দূর থেকেও নয়, সরাসরি দেশের ভেতরে তাঁরা কথাবার্তা বলছেন,
নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। নির্বাচন নিয়ে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং
পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ চাপকে পাশে ঠেলে
নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার। কোন ধরনের রাজনৈতিক
সমঝোতা না হলে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের আশঙ্কা করছেন অনেকে। জাতীয় সংসদ
নির্বাচন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভক্তি স্পষ্ট । ভারত, চীন এবং
রাশিয়া নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র
এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। এই লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র
ভিসানীতিসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো
দেশগুলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করছে। তফসিল ঘোষণার পর সেটি প্রত্যাখ্যান করে
বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপি শুধু একা নয়,
নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলোও তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। এলডিপি, কল্যাণ
পার্টি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অনেক দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের
দাবিতে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করে আসছে। তারাও তফসিলকে স্বাগত জানায়নি।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেও তারা মাঠে আছে। জাতীয় পার্টিও কোথায়
যাবে, কী করবে তা নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্ব
নিয়ে দলটিতে একটা ফেঁকড়া লেগে আছে। ফলে দলটির অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা
থেকেই যাচ্ছে। তবে আগের দুটি নির্বাচনে আমাদের দেশের ভোটারদের একটা বড়
অংশ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারবে কি না, সে
বিষয়ে তারা সন্দিহান। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণা হওয়ায় পুরো বিষয়টিই আরও জটিল
করে দিয়েছে। তফসিলের পর নির্বাচন কমিশনের যে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, সেটা
তারা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, সেটা কারও কাছেই বোধগম্য নয়। মূল বিষয় হলো
একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করার পরিবেশ তৈরি
হয়নি। সে ক্ষেত্রে যে নির্বাচনটি হবে সেটা শুধু দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বে
প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমন কথা বলছেন বিরোধীরা। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঠিক
কোন পন্থায় অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিতর্ক খুব
পুরনো। তত্ত্বাবধায়ক না দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে
সবসময় দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ছিল বিপরীতধর্মী
অবস্থান। বিএনপি যখন সরকারে ছিল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে
নির্বাচন চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যখন
সরকারে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল বিএনপি। ২০১৮
সালে দেশ যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, তখনও দেশের
প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে
ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে
নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকে। অন্যদিকে বিএনপি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের মতই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি জানায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সংবিধানের
বাধ্যবাধকতার কথা বলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের
অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল ছিল। কিন্তু বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে
রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকায় দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা কাজ
করছিল। তাই যেকোনো উপায়েই নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপির কেন্দ্র ও
তৃণমূল থেকে একটা চাপ ছিল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজ দাবি থেকে সরে এসে
বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত
চরম ভরাডুবি হওয়ায় এবার তারা এধরনের নির্বাচনে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন ২০২৪ সালের
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। (শুক্রবার)
থেকেই তাদের দলীয় প্রার্থী হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছে মনোনয়ন ফরম
বিক্রি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। উল্টো দিকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে
নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির মধ্যে পাওয়া
যাচ্ছে নানামুখী প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ মনে করছেন তফসিল ঘোষণা হলেও
বৈশ্বিক চাপে সরকারকে নির্বাচনের আগেই একটি সমঝোতায় আসতে হবে। আবার কারও
ধারণা তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ যেভাবে চাইছে
সেভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে এবং বিএনপি ধারাবাহিক কর্মসূচি
দিয়ে গেলেও সেটি নির্বাচন কমিশনকে বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন করা থেকে বিরত
রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। আমি বর্তমানে
কোনো রাজনীতি দেখতে পাই না। দেখতে পাচ্ছি ক্ষমতানীতি। যারা ক্ষমতায় আছে
তারা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় দীর্ঘায়িত হতে চায়। যারা ক্ষমতায় নাই তারা
বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে ক্ষমতায় যেতে চায়। সে যাই হোক রাজনীতি ময়দানে
এখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা। এদিকে একতরফা অবৈধ তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকায়
বিক্ষোভ মিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। শুক্রবার বাদ জুমা রাজধানী
ঢাকার বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর
দক্ষিণের উদ্যোগে এ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে
সমাবেশ শেষে তাদের মিছিলটি বায়তুল মোকাররম, পল্টন মোড়, বিজয়নগর পানির
ট্রাংকি ঘুরে হাউজ বিল্ডিং চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। একতরফা নির্বাচনের তফসিল
বাতিলের দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে খেলাফত মজলিস।একতরফা তফসিল
বাতিলের আহ্বান বাংলাদেশ স্বতন্ত্র প্রার্থী ঐক্য পরিষদের।আজ্ঞাবহ
নির্বাচন কমিশনের নীল-নকশার তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল
কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।নির্বাচন কমিশনকে সাবেক
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পরিণতির ভয় দেখিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র
যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা.
মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেছেন, আওয়ামী সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুঃশাসন,
লুটপাট ও অর্থপাচার বন্ধে জনগণ রাজপথে শান্তিপূর্ণ অহিংস কর্মসূচি পালন
করছে এবং করবে। আর এই প্রহসনমূলক নির্বাচনী তফসিল দেশে অচলাবস্থা ও চরম
রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে তফসিল ঘোষণা করা
হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির ভারপ্রাপ্ত
মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অস্ত্র হাতে রাতের অন্ধকারে নয়, সরকার
গঠন করা হবে ভোটের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব সময় লক্ষ্য ছিল জনগণের
ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। ভোটের মধ্য দিয়েই সরকার গঠন হবে, অস্ত্র হাতে
না, রাতের অন্ধকারে না। এখন দেখার বিষয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ করে
কিনা। তবে আমি মনে করি দেশ ও জনগণের স্বার্থে একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও
সুষ্ঠু নির্বাচন হউক। কারন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার
মাধ্যমে গণতন্ত্রকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির. উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
লেখক ও গবেষক
|