আওরঙ্গজেব কামাল
রাজনীতির যাতাকলে পিশে সাধারন বর্তমানে মানুষ নাজেহাল হয়ে পড়েছে। আর সেই
কারনে এখন গণতন্ত্র রয়েছে লাইভ সাপোর্টে। নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে
আসছে ততই রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে এবং গণতন্ত্র ক্রমেই কোমায় চলে
যাচ্ছে।এছাড়া নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের চাপ। গত বছর পশ্চিমা জোটের ১৪টি
দেশের রাষ্ট্রদূত নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি অবাধ,
মুক্ত, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের প্রতি আশা ব্যক্ত করেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো
শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ বা উল্লেখ
লক্ষণীয়। আমি মনে করি এটা গণন্ত্রের জন্য হুমকী। আগামী জাতীয় সংসদ
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর
বিদেশিদের চাপ বাড়তে থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের
চাপ আমলে নিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি
বলেন, এমন কোনো চাপ নেই, যেটা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। এটা মাথায় রাখতে
হবে। তিনি মন্তব্য করেন, বিদেশিদের যে চাপই আসুক না কেন, জনগণের স্বার্থে
যা করা দরকার, সরকার সেটাই করবে। এছাড়া খুব একটা স্বস্তিতে নেই প্রধান
বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিও। বিশেষ করে সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয়
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে এক দফা দাবিতে তারা মাঠে
আন্দোলন করছে তারা, তাতে প্রকাশ্য সমর্থন দেননি কোনো বিদেশি বন্ধু দেশ।
বরং বিভিন্ন বৈঠকে সহিংসতার পথ বর্জন করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরামর্শ
দিয়েছেন তারা। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি বলেছে, শেখ হাসিনার
অধীনে তাঁরা নির্বাচনে যাবে না। সমস্যা কোন ক্রমেই কমছে না। সেই সুযোগে
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের আখের গোছাতে ব্যস্তসময় পার করছে। রাজনীতির এই
সুযোগে একশ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্রব্যের মুল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে ফলে
সাধারন মানুষ পড়েছে বিপাকে। এসব ব্যবসায়ী সরকারের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা
করছে। বর্তমানে বাজার তাদের দখলে। প্রতিদিন দ্রব্যের মুল্য বাড়ছে। সাধান
মানুষের মধ্যে হাকার চরমে। সংসার চালাতে তারা হিমসীম খাচ্ছে। এছাড়া তারা
রয়েছে আত্নঙ্কে কখন যে কি হয়। আগে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলের
নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতেন। এখন তা আর লক্ষ করা
যায় না। যদিও কেহ আসে তা সম্পূর্ন লোক দেখানো।বর্তমানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি
নিম্নস্তরে পৌঁছেছে। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ এখনো ঘটেনি। রাজনৈতিক প্রথা ও
প্রতিষ্ঠানগুলো অবক্ষয়িত হয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি।
দুর্নীতিতে সয়লাব হয়েছে দেশ। সুশাসন পরিত্যক্ত হয়েছে। জনগণের জীবনযাত্রা
দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আমরা এখনো গণতন্ত্র খুজি? গণতন্ত্রের মূল
বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নির্বাচন হলো
`গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা` । সে নির্বাচন হতে হবে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ এবং
নিরেপেক্ষ।যে দেশে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং জবরদখল হয় সেটিকে
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে নারাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। বর্তমানে নির্বাচন
নিয়ে ভয় সকল রাজনৈতিক দলের কারন যখন যে ক্ষমতায় থাকে সে নির্বাচনে
কারচুপি এবং জবরদখল করে। তাই আজ গণতন্ত্রকে পূর্ণ জীবীত করতে বিদেশীদের
কাছে ধর্ন দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি। এ পরিস্থিতি ব্যর্থতার দায়ভার কোন
ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের নয়। এই ব্যর্থতা গোটা জাতির। আর এ অবস্থা থেকে
উত্তরণের জন্য গোটা জাতিকেই উদ্যোগী হতে হবে। এদিকে বাংলাদেশে বিগত দুটি
নির্বাচনের মতো কোনো নির্বাচন হোক, সেটি চান না বিদেশিরা। কিন্তু
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন কোন ধরনের সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সেই
ইস্যুতে কোনো মত দিতে রাজি নন তারা। তবে ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার পদত্যাগও চান না তারা। বর্তমানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা
নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে এবং এ
ব্যাপারে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো প্রকার ছাড় দেয়ার মানোভাব দেখা
যাচ্ছে না। নির্বাচনের আর মাত্র হয়তো তিন মাসের মতো সময় বাকী থাকতে দুই
প্রধান দলের মধ্যে এই অনাস্থা ও বিরোধপূর্ণ অবস্থান রাজনীতিতে সংকট
সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা বলেছেন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন
আন্দোলনের মাধ্যমে এবার নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য
করা হবে। আওয়ামী লীগের আন্দোলন ও দাবির মুখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ।
২০১১ সালে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে
সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। গত ২০১৪ এবং ১৮’র নির্বাচনে কিন্তু
সংসদ রেখে নির্বাচন হয়েছে। বর্তমান সংবিধানে সপ্তম ভাগে ১২৩ অনুচ্ছেদে
নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। যেটি হলো - “মেয়াদ অবসানের
কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই
দিনের মধ্যে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া
যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। এদিকে বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী
নির্বাচকালীন সরকারের যে বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে সেটিও বিএনপির
কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি বলছে বাংলাদেশের সংবিধান বার বার পরিবির্তিত
হয়েছে বার বার লঙ্ঘিত হয়েছে। কাজেই সংবিধান লঙ্ঘন হবে তার দোহাই দিয়ে
মানুষের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখা এটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনো কথা নয়। এখন কি
ভাবে সমস্যার সমাধান হবে এটা ভাবার বিষয়। তাহলে কি এক তরফা নির্বাচন হবে?
আর যদি হয় সেটা কতটুকু গ্রহনযোগ্য হবে? তাহলে কি আবাও আমরা সংঘাতের দিকে
ধাপিত হচ্ছি? আমি জানি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচন ডিএনএর মতো।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং একসময় তারা
অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে। একটি রাজনৈতিক দল অধীর আগ্রহে নির্বাচনের জন্য
অপেক্ষা করে, কারণ তারা জানে, শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই তাদের
ক্ষমতায় আসার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে। আর কিছু না হোক, তারা অন্তত এর
মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ও মনে জায়গা করে নিতে পারে। সুতরাং, যখন একটি
রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সংঘাত হওয়ার
আশংখ্যা কয়েক গুন বেড়ে যায়। বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক সরকারের
অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাহলে বিষয়টি আমাদের ক্ষেত্রে কেন এত
ঝামেলাপূর্ণ?১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারাই কার্যকর
আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাদের যুক্তি
ছিল, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব
নয়। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে
অনুষ্ঠিত হয় (১৯৯১ সালের নির্বাচনের আয়োজন করে একটি `অন্তর্বর্তীকালীন
সরকার`)। সবশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় সামরিক বাহিনী সমর্থিত
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে
ক্ষমতায় আসে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল। (যদি ২০০৮ সালের নির্বাচন তৎকালীন
প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের অধীনে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে খুব সম্ভবত
আওয়ামী লীগ জিততেই পারতো না। কারণ ৮ কোটি ১১ লাখ ভোটারের তালিকা থেকে
পরবর্তীতে ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাদ দেওয়া হয়।)২০১১ সালে সুপ্রিম
কোর্টের একটি `সংক্ষিপ্ত রায়ের` ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম মুছে দেয়। ২০১৪ সালের সংসদ
নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য `বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায়` নির্বাচিত হন।
এখানে কি রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়নি? তাহলে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের কথা রয়েছে। ঐ নির্বাচন কেমন হবে এ
প্রশ্ন সকলের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। একটু পিছনে ফিরলে দেখা যায়,১৯৭১ সালে
স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের
সম্পর্ক বেশ ভঙ্গুর। স্বাধীনতার প্রথম কয়েক দশকেই একাধিক অভ্যুত্থান এবং
পাল্টা অভ্যুত্থান দেখে বাংলাদেশ। হত্যা করা হয় দেশটির প্রথম
রাষ্ট্রপতিকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে একদলীয়, সামরিক,
গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী- সবধরনের শাসন ব্যবস্থাই দেখা গেছে। দ্য
ওয়ার্ল্ড জুরিস্ট প্রজেক্ট’-এর আইনের শাসন সূচকে ১৪০টি দেশের মধ্যে
বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭ তম। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক
দলকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ
দেখা যাচ্ছে না। বরং সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বক্তারা।
বর্তমান সংকটটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দুই দিকেই। অনেক সংকটের মূলে আছে
রাজনীতি, কিন্তু সমাধান করতে হবে এটা সকল জনগণের দাবী।
লেখক ও গবেষক
|