নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সমজোতার অভাব
দেখাদিয়েছে। ক্রমেই আস্থাহীন হয়ে পড়ছে সরকার বিরোধীরা। যদিও সরকার বারবার
তাদের আস্চত করার চেষ্টা করছে তবুও কোন ফল হচ্ছে না। আর এই সুযোগে
প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে বার নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ সব কারনে
চরম বিপাকের মধ্যে রয়েছে জনসাধারন। একদিকে দ্রব্যের মুল্য বৃদ্ধি অপরদিকে
রাজনৈতিক সমস্যায় কোন কুল কিনার করতে পারছে না সর্বস্তরের সাধারন
জনসাধারন। রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কল্পনা করা যায়
না। দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের উপর যে কোন সরকার ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর
করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের সাথে কার্যকরী
নেতৃত্ব আবশ্যকীয়। এই ইউনিটের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে নেতৃত্বের ভূমিকা বিশ্লেষণ অতি প্রয়োজন । আমি মনে
করি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার অনেক
বেশী । কারন রাজনৈতিক দলগুলি মধ্যে সমজোতা না হলে দেশের চরম ক্ষতি হবে।
সাধার জনগণের জান ও মালের হানীর সম্ভানা বেড়ে যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক
দলগুলোর মধ্যে আদৌ কি সংলাপ বা সমজোতা করা সম্ভব? আর এই সংলাপ বা সমজোতা
হলে তা কিভাবে হতে পারে, কারা সংলাপ বা সমজোতা দায়ভার নিয়ে সফল করবে?
এমন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন মহলে প্রতিনিয়ত
আলোচিত হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দশম জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচন-পূর্ববর্তী কয়েক মাসের অবরোধ, হরতাল ও
সহিংসতার অবসানে জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। নতুন সরকার নিজ অবস্থান সংহত
করতে প্রয়াসী হয় এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নীতি প্রণয়ন ও
বাস্তবায়নে তৎপরতা প্রদর্শন করে। অপরদিকে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন
২০-দলীয় জোট আন্দোলনে আপাত ব্যর্থতার পর সহিংস কর্মসূচি থেকে সরে এসে
অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সমস্যা মোকাবিলা করে নব প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের
পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এর পর থেকে বিরোধী জোটের
বিভিন্ন কর্মসূচি দিলেও তা কোন ভাবে সফল পায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান
রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো এক প্রকার ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা
করে চলছে । আমরা জানি রাজনৈতিক সমঝোতার বড় বাধা নিষ্পত্তি হওয়া জাতীয়
কিছু সংসদীয় আইন। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক ইস্যুতে সমঝোতা না হয়ে দ্বন্দ্ব
বিরাজ অবশ্যই। রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতার পালা বদল হয়েছে এবং দেশ
পরিচালনা করেছে কয়েক দশক ধরে। পরিবর্তন করেছে রাষ্ট্রের মূল দর্শন
ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা ও ন্যায়বিচার। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং
দেশের জাতীয় সংহতির স্বার্থে রাজনৈতিক সংঘাত ও দ্বন্দ্ব নিরসনের কোন
ব্যবস্থা কেহ করেনি। বাংলাদেশে সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির
প্রেক্ষাপটে ক্রমান্বয়ে আস্থা নির্মাণের উদ্যোগ অসহনশীল বা অবিশ্বাস
ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে অসংখ্যবার
সংলাপের আয়োজনের বা তাগিদ দেওয়া হয়েছে তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। শুরু
বিরোধীরা বিরোধীতা করছে এবং সরকার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের যাইগা
শক্ত করার চেষ্টা করছে। এখন আমরা কি এটাও ধারণা করতে পারি যে, যা কিছু
হচ্ছে তার সবই দলীয় স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে বা জনগনের স্বার্থে নয়।
এটা আমাদের রাজনীতিতে বিদ্যমান অসুস্থ ধারার চমক ছাড়া কিছু নয়। এখানে
অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছুর গুরুত্ব নেই। যে
দলটি ইতোমধ্যে ক্ষমতায় আছে, তাদের একমাত্র চিন্তা হচ্ছে কীভাবে সেখানে
টিকে থাকা যায় । অপরদিকে বিরোদীদের চিন্তা জান মালের যা ক্ষয় ক্ষতি হয়
হউক যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় যেতে হবে। আর তাদের এই প্রতিদ্বন্দ্বীতায়
সাধারর জনগনের কি হবে একবার কেহ ভেবে দেখছে না। এসব বিষয় আমরা আলোচনা
করতে পারি না কারণ, রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা পুরোনো ধ্যান-ধারণার
মধ্যেই আটকে আছি। আমাদের মাথার উপর আইনের মারপেচ রয়েছে। তবুও দেশের
সার্থে জনগনের সার্থে কিছু বলতে হচ্ছে। ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত
সরকারের ২ বছর ছাড়া গত ৩২ বছরে আওয়ামী লীগ (প্রায় ২০ বছর) ও বিএনপি (১০
বছর) দেশ শাসন করেছে। সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে তারা
সবচেয়ে বেশী শত্রুতে পরিণত হয়েছে এবং একে অপরকে নির্মূল করার খেলায় মত্ত
হয়েছে। দেশে রাজনীতিতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল আগেও ছিল; তবে এমন
ঘনীভূত আস্থার সংকট বোধকরি কখনোই ছিল না। আস্থাহীনতার বিপরীত মেরু থেকে
ঐকমত্যে পৌঁছা বা সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়ার পথ যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে
গেছে। এ জন্য ‘পারস্পরিক দোষারোপ, প্রতিহিংসার রাজনীতি ও ক্ষমতার মোহ’
দায়ী। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করা ও প্রতিযোগিতা
গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ কিন্তু ‘একমাত্র আমিই সঠিক’ এ দৃষ্টিভঙ্গি সংকট
জিইয়ে রাখে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত। সর্বস্তরের মানুষ আশা
করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব
দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ হোক। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া সেটা অসম্ভব।
রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি যে আস্থাহীনতা সেখানে একসঙ্গে বসা ও আলোচনার
মাধ্যমে সমঝোতার পথ খুঁজে বের করার অবস্থা নেই। যে কারনে দেশের রাজনীতিতে
বিদেশীরা হুকিঝুকি মারছে। এবং সুবিধা আ;য়ের চেষ্টা করছে।প্রতিটি দেশে
‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার’ একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য
নির্বাচিত হন। একইসঙ্গে প্রতিনিয়ত বিরোধী দলের মাধ্যমে জনগণের কাছে
জবাবদিহি অব্যাহত রাখে। সবচেয়ে বড় কথা আস্থা হারালে যে কোনো সময় সংসদ
ভেঙে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়, এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। নিকট অতীতে মাত্র
১ বছরে কয়েকবার সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে খোদ যুক্তরাজ্যে। আমাদের
দেশে আস্থা হারানো দূরের কথা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায়
আসীন সরকার শুরুতেই আস্থা নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। গত ৫ দশকের বাংলাদেশে যে
কোনো বিবেচনায় দুটি প্রধান রাজনৈতিক ধারা বা শক্তি বিদ্যমান। একটি খালেদা
জিয়ার নিরঙ্কুশ নেতৃত্বাধীন বিএনপি, আরেকটি শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ
নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এদের কাছাকাছি তৃতীয় কোনো উল্লেখযোগ্য শক্তি
সংগঠিত হতে পারেনি এখনো। ফলে সমজোতা হলে তাদের মধ্যে হতে হবে। তবে
নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি আছে অথচ এ ধরনের কোন আলামত লক্ষ করা
যায়নি। নির্বাচনের ৬ মাস আগে এর একটা ব্যবস্থা হওয়ার অতি প্রয়োজন।
এমতাবস্থায় কোনো পক্ষই প্রতিপক্ষকে আস্থায় নিতে পারছে না। দেশের
অভ্যন্তরে সিভিল সোসাইটির সদস্যদের মাঝে বিভক্তির কারণে সমঝোতার লক্ষ্যে
উল্লেখযোগ্য তৎপরতা দেখা যায়নি। বিদেশিদের নজরদারি কিংবা ভিসানীতিসহ
বিভিন্ন পদক্ষেপ সরকারকে কিছুটা বিব্রত করলেও ছাড় দেওয়ার মতো চাপ অনুভব
করছে না বলেই প্রতীয়মান হয়। রাজনীতিতে ভুল বা অন্যায় আচরণের কারণে একটি
দেশের যতখানি ক্ষতি হয় অন্য কোনো কারণে তা হয় না।সুষ্ঠু নির্বাচন
গণতন্ত্রের প্রাণ। ইউরোপ-আমেরিকার উন্নয়নের পেছনে বড় কার্যকর শক্তি হলো
গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও অনুশীলন। তাই আমি বলবো সাধারন জনগনের কথা
চিন্তা করো উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। একটি সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যেমে
বাংলাদেশের গনতসবত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের
রাজনীতিবিদদের মধ্যে উদারতা, সহনশীলতা ও ক্ষমাশীলতার গুণ দান করুন এবং
পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশ ও জাতির স্বার্থে সমঝোতায় উপনীত
হওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক ও গভেষকঃ
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব
|