বর্তমানে ব্যাপক হারে বেড়েছে সাংবাদিক সংগঠন। বেড়েছে সাংবাদিকতার
সুবিধাবাদী নেতা। কিন্ত বাড়েনি সাংবাদিকতার মান। যে কারনে ক্রমেই
অপসাংবাদিকতা বেড়েই চলেছে। এসব সুবিধাবাদী কথিত সাংবাদিক নেতা
সাংবাদিক না হয়েও অনেকে নেতাগিরি করছে। এমনও সাংবাদিক নেতা রয়েছে যারা
বছরে ও দু একটি নিউজ করেন না। অর্থের বিনিময়ে পত্রিকা বা মিডিয়ার কার্ড
সংগ্রহ করে বহাল তবিযতে করছে সাংবাদিকতার নেতাগিরি। আর এইসব নেতারা
সাংবাদিকদের সুবিধা আদায়ের কথাবলে নিজেরাই সুবিধা ভোগ করছে। আমি জানি
একমাত্র সাংবাদিকতা পেশায় সাংবাদিক পরিচয় দিতে কোন সার্টিফিকেশন বা সনদ
প্রয়োজন হয় না। এর ফলে যে কোন মানের লোকজন এ পেশায় আসছে। আবার সাংবাদিক
না হয়েও কখনো সাংবাদিকতা না করেও এখন অনেকে সাংবাদিক নেতা। অর্থের দাপটে,
ক্ষমতার দাপটে তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। যেখানে পেশাদার
সাংবাদিক বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য বড় হচ্ছে, সেই
সঙ্গে বাড়ছে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনসহ অনলাইনের সংখ্যা। তবে সাংবাদিকতার
মান কতটুকু বেড়েছে? এর ব্যাখা নাই দিলাম। একটা কথা বলা প্রয়োজন-
সাংবাদিকদের সংগঠন বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। হাতেগোনা কয়েকটি সংগঠন ছাড়া
অধিকাংশ সংগঠন নিজেদের সার্থে সংগঠনগুলি পরিচালনা করছে। সভাই এখন সংগঠনের
প্রধান হতে চায় ফলে অধিকাংশ সংগঠনে দুএক জন নেতা ছাড়া অনন্য কাউকে খুজে
পাওয়া যায় না। আমার প্রশ্ন এসব সংগঠন কেন হচ্ছে? নতুন নতুন সংগঠন তৈরী
করে লাভ কি। মানুষ সাংবাদিকদের এসব সংগঠনকে নানাবিধ ব্যঙ্গ করেন। একটু
সার্থে কমতি পড়লে দু একজন সাংবাদিক সাথে নিয়ে তৈরী করছে সাংবাদিক সংগঠন।
তারপর এরা পদমর্যাদা ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধা আদায় করছে। বর্তমানে
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যে কোন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা একটি টেলিভিশন
চ্যানেল, একটি অনলাইন খুলে যে কোন যোগ্যতার একজনকে বিভিন্ন পদে বসিয়ে
দিতে পারেন। তার যোগ্যতা লেখাপড়া বা অভিজ্ঞতার চেয়েও বড় দরকার তার
আনুগত্য। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও সে সাংবাদিক হয়ে গেলো। আসলে এটা
ঠিক না। যে কারনে সাংবাদিকতার মত মহান পেশার প্রতি সমাজে আজ নেতিবাচক
প্রভাব পড়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো আজকাল ফুটপাতের ফল ও চা-পান দোকানীরাও
টাকার বিনিময়ে সংবাদ মাধ্যমের আইডি কার্ডের অধিকারি হয়ে সম্মানের সাথে
নিজেদেরকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে মহান পেশা সাংবাকিতাকে কলংকিত
করছে। তাদের প্রভাবে পেশাদার সাংবাদিকরা এখন নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিতে
লজ্ঞা বোধ করে। আসল কথা হলো সাংবাদিকতা সব সময় একটি আলোচিত পেশা। আর এই
পেশার নেতাদের হতে হয় আদর্শবান। তার সংবাদকর্মী ও সংবাদমাধ্যম শিল্পের
সার্বিক উন্নয়নকল্পে একটি সরকারি নীতিমালা প্রনয়নের জন্য সরকারের প্রতি
সাংগঠনিকভাবে অনুরোধ/ দাবী জনানো যোগ্যতা সম্পন্ন ।সংবাদকর্মীগণ
অন্যায়ভাবে কোন মিথ্যা মামলা কিংবা হামলার শিকার হলে তাৎক্ষনিক তার সরব
প্রতিবাদসহ ভূক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা প্রদান করার ক্ষমতা ও
জনপ্রীয়তা। সংবাদকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষে প্রয়োজনীয়
প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা সহ দেশ,জাতি ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিতপ্রান হয়ে কাজ
করার অনুপ্রেরণা মূলক মোটিভেশন দেয়ার যোগ্যতা। সংগঠনের ঐকান্তিক
প্রচেষ্টায় একটি ফান্ড গঠন করে সেখান থেকে সদস্য ও তার পরিবারের সদস্যের
জন্য শিক্ষা ,চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকল্পে কাজ করার
যোগ্যতা। একজন সাংবাদিক সাধারণ মানুষ কী জানবে, কতটুকু জানবে বা কতটুকু
দেখবে সেটি অনেকটা নির্ভর করে সাংবাদিকদের দক্ষতা, যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব
এবং নিরপেক্ষ মননের ওপর। ঘটনার ‘কর্তা’র সাথে সাথে তাই সাংবাদিকরাও
প্রাসঙ্গিক হয়ে আলোচনায় থাকছেন। কিন্ত এবিষয়ে নামধারী সাংবাদিক বা কথিত
সাংবাদিক নেতাদের এ বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। আর থাকবে বা কি করে তারা তো কেহ
সাংবাদিক নহে। শুধু নিজেদের রক্ষা করতে অনন্য পেশা থেকে এ পেশায় এসেছে।
আর এসব অপসাংবাদিকদের কারনে গোটা পেশাজীবী সাংবাদিক এখন নানাবিধ সমস্যার
সন্মূখিন হতে দেখাযাচ্ছে। এছাড়া রাজনৈডিতক নেতাদের পা চাটা কিছু সাংবাদিক
বা সাংবাদিক নেতারা প্রকৃত সাংবাদিকদের নাজেহাল করছে। তার সবসময় নিজেদের
জাহের করতে, অপর সাংবাদিককে নানাবিধ সমস্যায় ফেলতে পিছপা হচ্ছে না। এছাড়া
কিছু রাজনৈতিক নেতারা অর্থের বিনিমযে সাংবাদিক পেশায় ঢুকে প্রকৃত
সাংবাদিকদের উপর ছড়ি ঘোড়াচ্ছেন। তারা এখন কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই পত্রিকা বা
মিডিয়ার মালিক বনে গেছেন।আমরা জানি,সাংবাদিকতা কি কুসুমাস্তীর্ণ পেশা?
কখনও কি ছিল? সব সংকট বা চ্যালেঞ্জ পায়ে দলেই তো সাংবাদিকতা এগিয়েছে যুগ
যুগ ধরে। সময়
পাল্টেছে, সংকট বা চ্যালেঞ্জও ভিন্ন চেহারা নিয়েছে কিন্তু সাংবাদিকতা
থেমে তো থাকেইনি বরং এগিয়েছে আরও নতুন উজ্জ্বলতা নিয়ে। সাংবাদিকতা হচ্ছে
সবচেয়ে জীবন্তু ও আধুনিক পেশা। বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা, সাংবাদিকতা কখনই
মূর্খজনের পেশা নয়, পেশা হিসেবেই সাংবাদিকতা বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের পেশা।
যে মানুষ অতীতকে ধারণ করে বর্তমানের সঙ্গে তা মিলিয়ে ভবিষ্যতের নির্দেশনা
দিতে না পারেন, ভাষায়-ব্যাখ্যায়-উপস্থাপনায় যিনি মেধার ছোঁয়া না বুলাতে
পারেন তিনি আর যা-ই হোন সাংবাদিক হতে পারেন না। কিছু মৌলিক কাঠামোই
সাংবাদিকতাকে আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
সাংবাদিকতাকে দাঁড়াতে হয় এই মৌলিক ভিত্তির উপর। আর এ থেকে একটু বিচ্যুতি
ঘটলে পড়তে হয় নানাবিধ সমস্যায়। আমি মনে করি এসব কারনেই সাংবাদিকদের উপর
নেমে আসে নির্যাতন,হুমকী,মামলা ও হামলার ঘটনা। আটিকেল নাইনটিন-এর
তথ্যমতে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে সবসময় সরকারের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ
হয়েছে। সাংবাদিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এই
পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে ‘কার্যত অস্তিত্বহীন’ বলে উল্লেখ
করেছেন ঐ সংস্থার প্রধান। ২০২৩ সালে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত
৬ মাসে সাংবাদিক নির্যাতনের সংখ্যা ১৫০ জন সাংবাদিক খুন, হামলা, মামলা,
গ্রেফতার, নির্যাতন, হুমকিসহ নানাভাবে আক্রান্ত ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
এরমধ্যে জানুয়ারি ও জুন মাসে খুন হয়েছেন ২ সাংবাদিক। অস্বাভাবিক মৃত্যু
হয়েছে আরও ৩ জনের। মার্চ মাসে সর্বাধিক ৪০ জন সাংবাদিক নিপীড়নের মুখে
পড়েন। অন্য ৫ মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, এপ্রিলে ২৪
এবং মে মাসে ১৪ জন এবং জুন মাসে ২৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নিগৃহীত
হয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকসহ ডিজিটাল আইনে হয়রানিমূলক মামলার
শিকার হয়েছেন এদের অনেকে। গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটতে হয়েছে ৭ জনকে। প্রথম
সারির সংবাদপত্র ও শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টালে নজর রেখে বাংলাদেশ
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মনিটরিং কমিটি সাংবাদিক নিপীড়নের এ
চিত্র পেয়েছে। রাজধানীর পল্লবীর বাসা থেকে সিনিয়র সাংবাদিক বিপ্লব
জামানের অর্গগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫ জন সাংবাদিক
হামলা, মামলা, নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হন। এর মধ্যে ১২ জন হামলায় আহত
হয়েছেন। মার্চ মাসে ৪০ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নিপীড়ন ও
হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ২১ জন সাংবাদিক হামলায় আহত হয়েছেন।
এপ্রিল মাসে ২৪ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নিপীড়ন ও হেনস্তার
শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ১৪ জন সাংবাদিক হামলায় আহত হয়েছেন। ৪টি স্থানে
মামলায় আসামি হয়েছেন ৮ সাংবাদিক। এছাড়া মে মাসে ১৪ জন সাংবাদিক
হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ৮ জন সাংবাদিক হামলায় আহত হয়েছেন।
২টি স্থানে মামলায় আসামি হয়েছেন ২ সাংবাদিক। ৪ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার
হয়েছে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক-২০২৩-এর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,
গত দুবছরে বাংলাদেশ (গণমাধ্যম সূচকে) ১১ ধাপ ও ১৪ বছরে ৪২ ধাপ নিচে
নেমেছে। যে বিষয়গুলোর ওপর এই সূচক নির্ধারিত হয়, তার অন্যতম একটি বিষয়
হলো সাংবাদিকের নিরাপত্তা। আর ঠিক সেখানেই বাংলাদেশের স্কোর হতাশাজনকভাবে
কম। দেশে বারবার সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার
সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিচার না হওয়া, ‘অদৃশ্য শক্তির’
প্রভাবে ছাড় পেয়ে যাওয়ার ফলে দেশে এ ধরনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি
পাচ্ছে তা বলাবাহুল্য। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস
ঘটনার বিচারিক তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি
গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য চরম বাস্তবতা হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিচারহীনতা,
সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমে
নিঃসন্দেহে এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আর এই সমস্যা থেকে পরিত্রান
পেতে অবশ্যই প্রয়োজন আদর্শ সংগঠন ও আদর্শ নেতা। এখন সময় এসেছে এসবের
পরিবর্তনের। সাংবাদিকতা পেশায় সাংবাদিক কারা তা চিহ্নিত করা হোক। গড়ে
উঠুক একটি আদর্শ সাংবাদিক সমাজ।
লেখক ও গভেষকঃ
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব
|