আওরঙ্গজেব কামাল
বর্তমানে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকদের
স্বাধীনতা। নানাবিধ কারনে সাংবাদিকতা এখন ক্রমেই হয়ে উঠছে কঠিন থেকে
কঠিন।শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন সাংবাদিকরা কোন ফল পাচ্ছেন না।
স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সংবাদিকদের এখন সমস্যার যেন শেষ
নেই। প্রতি নিয়ত সাংবাদিক হত্যা,গুম,হয়রানী,মামলা ও হামলার শিকার হচ্ছে
অথচ ন্যার্য বিচার থেকে বঞ্চিত। ২০০৮ সাল থেকে ১৪ বছরের মুক্ত
গণমাধ্যম সূচকে ৪২ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে আরও একধাপ পিছিয়ে
১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৬৩তম। এখন বলুন
সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখন ভিন্ন ভিন্ন নামে এ
পেশায় অনেকে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে
নিজেদের পরিচয় দিলেও এখন তারা সাংবাদিকদের নিজেদের দাসত্ব বানানোর
পায়তারা করছে। আমরা জানিকোন দেশ গণতান্ত্রিকভাবে কতটুকু শক্তিশালী, সেটি
পরিমাপে যেসব নির্দেশক রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের
স্বাধীনতা এই নীতিটি যে মুদ্রিত এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, বিশেষত
প্রকাশিত উপকরণগুলি সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার ও মত প্রকাশের স্বাধীনভাবে
ব্যবহার করার অধিকার হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের
স্বাধীনতা ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। এবছর সেই সংকটের চিত্রটা খুবই
স্পষ্ট। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সরকারগুলো গণমাধ্যমকে একটি
প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। যখন যে সরকার আসে তখন সে
সরকারের হয়ে কাজ করতে হয় গণমাধ্যমের এটাই বাস্তব। ক্ষমতাসীন দলের
নেতাকর্মীদের চক্ষশূলে পরিণত হওয়া সাংবাদিকদের বরণ করতে হয় নানা রকম
হয়রানি ও নির্যাতন। এছাড়া বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সরকারের তৈরি নানা আইনের
মারপ্যাঁচে চেপে রাখা হয় সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কণ্ঠ। ফলে সরকারের কথা বা
কাজকে চ্যালেঞ্জ করার ‘দুঃসাহস’ দেখাতে পারে না কোনো সংবাদমাধ্যম। যে
কারনে প্রতিনিয়ত সাংবাদিক লাঞ্চিত অবহেলিত এবং মামলা ও হামলার শিকার
হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী মানের দিক থেকে গণমাধ্যমের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম
কারণ জড়িয়ে আছে অর্থনীতির সাথে। দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমই শীর্ষ
ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। অর্থনীতির পরিসর বৃদ্ধির সাথে সাথে গণমাধ্যমের
বিস্তৃতিও ক্রমশ বাড়ছে তাদের । কিন্তু সাংবাদিকরা কোন সুযোগ সুবিধা
পাচ্ছেন না। তার কারন ব্যবসায়ীরা নিজেদের রক্ষা করতে পত্রিকা বা মিডিযার
মালিক হযে শ্রেণি গণমাধ্যমের মানের চেয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক চাকা সচল
রাখার বিষয়ই আগে ভাবেন। ফলে ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় বা শাসক
শ্রেণির রোষানলে পড়তে হয় এমন ভূমিকা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে গণমাধ্যমগুলো।
এছাড়া মালিক শ্রেণির রাজনৈতিক আদর্শও প্রবলভাবে ফুটে উঠে নিজ নিজ
গণমাধ্যমে। এতে সাংবাদিকরা যেমন উৎসাহ হারান, একইসাথে তারা নিরাপত্তা
সংকটে ভোগেন। এক্ষেত্রে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমের চিত্রই প্রায়
অভিন্ন। এভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতির কবলে পড়ে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের
স্বাধীন সাংবাদিকতা। এছাড়া সরকারের একেক সময় একেক আইন আরো সাংবাদিকতাকে
বিপাকে ফেলছে। এখন আবার সাংবাদিকতার পরিচয় পত্র দেবে প্রেস কাউন্সিল
সেটাও নিয়ে অনেক সাংবাদিক উদ্বিগ্ন। সাংবাদিকদের দেখভাল করার জন্য ১৯৭৪
সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিল। এ যাবত প্রেস কাউন্সিল
থেকে যে ধরনের সুবিধা পেয়েছি তা কারো অজনা নেই। আজ গণমাধ্যম কতটা
স্বাধীন, এ্ নিয়ে বিতর্ক শেষ হবার নয়। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে।
সাম্প্রতিক চরম হেনস্তা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিকরা। এতে
বোঝা যায়, রাষ্ট্রশক্তি শুধু নয়, বেসরকারি দুষ্টশক্তিও নাগরিক মনে হিংসার
মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।এই আক্রমণ, এই নিগ্রহ, কখনো হত্যা করা
অনেকদিন ধরেই হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে স্থানীয় সাংবাদিকরা এই পরিস্থিতির
মুখোমুখি হচ্ছেন বেশি করে। একদিকে সংবাদ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা,
গণমাধ্যম কর্মীদের উপর নিয়মিত আক্রমণ আর অন্যদিকে তাদের জন্য সীমিত আইনগত
সুরক্ষা। এটাই আজকের বাংলাদেশের বাস্ববতা। একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো,
সীমিত স্বাধীনতা, চাকরির অনিশ্চয়তার সঙ্গে এদেশের সাংবাদিকদের কাজ করতে
হয় ভয় আর আতংককে সঙ্গী করে। কাজ করতে হয় আপস করে করে। সেই ন্যূনতম
স্বাধীনতাটুকুও এখন হুমকির মুখে। রাষ্ট্র এবং কর্পোরেটের চাপ, সামাজিক
মাধ্যমে কট্টর মতামত, পুলিশের অপব্যবহার, মিডিয়ার আপস মত প্রকাশের
স্বাধীনতার সামনে বিস্তর বাধা। এগুলো মোকাবেলা করতেই হচ্ছে, হবেও সামনের
দিনগুলোতে। রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলি সাংবাদিকদের ওপর বলপ্রয়োগ করে,
তাদের দমন করতে চায়, নানাভাবে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে উদ্যত, এবং
করেও। বাধা হয়ে আছে বেসরকারি ব্যবসায়ীরাও। আর তাই, গণমাধ্যমগুলির
বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি
বড় বিপদ তৈরি হয়। প্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন একদিন এই বৃত্ত থেকে
গণমাধ্যমকে বের করে আনবে বলেই বিশ্বাস করি এবং সেখানেই নিহিত থাকবে
সাংবাদিকরে স্বাধীনতার ধরণটি কেমন হবে তা আপনারা বলুন।এখন সাংবাদিকতা,
অপসাংবাদিকতার বাইরেও আরেকটি প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সেটি হলো
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্র এবং জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
গণমাধ্যমকে যখন কোনো সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা
হয় তখন তাকে বলা হয় ‘নো জার্নালিজম’। এ রকম কিছু সাংবাদিকতা এখন ফৌজদারি
অপরাধ। সাংবাদিকতার প্রটেকশন তার জন্য প্রযোজ্য হয় না। কারণ এটি
রাষ্ট্রদ্রোহিতা। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না। ফলে
সাংবাদিদের যাওয়ার আর কোন যায়গা থাকে না। সরকারের পক্ষে গেলে সমস্যা আবার
সরকারের বিপক্ষে গেলেও সমস্যা। স্বাধীন সাংবাদিকতার মূল প্রতিপক্ষ
রাষ্ট্র, এবং সেই রাষ্ট্র যারা তাদের সমালোচনা, অপকর্ম, দুর্নীতি বা
অপশাসন উদঘাটন কিংবা অগণতান্ত্রিক বা অমানবিক কর্মকাণ্ডগুলোর প্রচার
সইবার মানসিকতা রাখে না। অথচ স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতান্ত্রিক স্বাধিকার ও
উন্নয়নের স্বার্থে অপরিহার্য। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের নিরিখে দেখেছেন; তাঁর
মতে, তথ্য সরবরাহ করায় বাধা থাকলে তা সরকারকে একনায়কত্বের পথে ধাবিত করে,
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনেও সহায়ক হয় না। আমরা যদি কেবল দক্ষিণ
এশিয় রাষ্ট্রগুলোর সাংবাদিকতার পরিস্থিতি বিবেচনা করি, দেখতে পাই, অনেক
রাষ্ট্রই নিবর্তনমূলক আইন প্রবর্তন করেছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র নিত্যনতুন
আইন করে নানা সত্যকে ধামাচাঁপা দিতে স্বচেষ্ট হচ্ছে। সুখের বিষয়
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সিভিল সোসাইটির ক্রমবর্ধমান বিকাশ,
তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত এবং প্রায় অপ্রতিরুদ্ধ অগ্রযাত্রা এবং প্রতিটি
জনগোষ্ঠীর মুক্তবুদ্ধিবৃত্তি ও তার মনোজাগতিক বিকাশ এই প্রবণতার বিরুদ্ধে
শক্ত প্রতিরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সরকার ইচ্ছে করলেই সবকিছু করতে পারছে
না। মুক্ত তথ্য প্রবাহ থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
বলাই বাহুল্য, তথ্য লাভের অধিকার একটি স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার যুগের
দাবি যা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের বাইরেও
বর্তমান যুগে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে সামাজিক গণমাধ্যম, যা মানুষের
হাতের নাগালে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তথ্যসমৃদ্ধ করে মানুষকে। সামাজিক
গণমাধ্যমগুলোর ভালোমন্দ দিক বা কুপ্রভাব নিয়ে অবশ্যই বিতর্কের অবকাশ আছে।
সহজলভ্য ও তথ্যের দ্রুত বিস্তার ঘটায় বলে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী
এর বিস্তর অপব্যবহার করে। আবার অনেক দেশেই সরকার থেকে এগুলোর ওপর
বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় বিশেষ প্রয়োজনের কথা বলে। কিন্তু এ সবের পরও
সামাজিক গণমাধ্যমের প্রভাব ও বিস্তারকে অস্বীকার করার জো নেই। বলতেই হবে,
যুগের বিবর্তনে রাষ্ট্রশক্তিই কেবল স্বাধীন সাংবাদিকতার একমাত্র
প্রতিপক্ষ থাকেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুবিধ নতুন প্রতিপক্ষ যারা
শক্তিধর এবং মুক্ত, স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার ক্ষমতা রাখে,
নিয়ন্ত্রণ বা বিধিনিষেধে আবদ্ধ করে। আজকের দিনে স্বাধীন সাংবাদিকতা,
মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে যারা দণ্ডায়মান
আমরা ক্রমেই হয়তো তাদের দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্ত এখন সময়
এসেছে কথা বলতে হবে সাংবাদিকদের। অধিকার আদায় করতে হবে। কারন সাংবাদিকতা
সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ,
অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধাচারণ, দুর্বল জনগোষ্ঠীর পক্ষধারণসহ নৈতিকতার
ভিত্তি আছে বলে এ পেশা সমাজকে এগিয়ে নেয়, গণতন্ত্রকে বিকশিত করে,
অনুপ্রাণীত করে। আমার বিশ্বাস, বস্তুনিষ্ঠ শান্তিবাদী সাংবাদিকতা এ
প্রেক্ষাপটে যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ নৈতিকতা সম্পন্ন বলিষ্ঠ
সাংবাদিকতা একদিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে, নেতিবাচক বিষয়েই
কেবল সীমাবদ্ধ থাকে না, থাকতে হয় তাকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং নিরপেক্ষ
পর্যালোচনায় সমাজকে শিক্ষিত ও দায়িত্ববান করার দায়িত্বেও। অন্য সব পেশা
থেকে সাংবাদিকতার স্বাতন্ত্র্য এখানেই। কাজেই সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা এবং
পরিধি, দেশকালপাত্র নির্বিশেষে, নিরূপণের সুযোগ আমাদের খুজে নিতে হবে।
আমরা কে কতটা পারবো বা পারবো না তা তাদের নিজস্ব চেতনা ও সামর্থ্যরে
ব্যাপার। কিন্তু এ সত্য কখনোই অনস্বীকার্য নয় যে, সাংবাদিকতা সত্য ও
শান্তির স্বার্থে ভূমিকা রাখার উপযুক্ত বাহন। অবশ্যই স্বাধীন সাংবাদিকতা
প্রতিষ্ঠিত হবে এই প্রত্যাশা আমার।
লেখক ও গভেষকঃ
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব
|